গঠনগত দিক থেকে পৃথিবী নিয়ত পরিবর্তনশীল। সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত আছে। এ বিষয়টি ভালভাবে টের পাওয়া যায় পৃথিবীর ভূ-ভাগ অর্থাৎ জল এবং স্থলভাগের প্রতি লক্ষ করলে।
গড়াতে গড়াতে ভূপৃষ্ঠের পানির ঠিকানা হয় সমুদ্র, ঠিক যেমন নদীর পানি মিশে যায় সমুদ্রে। কিন্তু কোথায় যায় সেই পানি?
এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে গিয়ে ধাঁধাঁয় পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। আসলে বর্তমানকে জানতে হলে অতীত জানতে হয়। আর বর্তমান জানা হলে ভবিষ্যত সম্পর্কে আঁচ করা যায়। বিজ্ঞানীরাও একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। গত ত্রিশ বছর ধরে ভূপৃষ্ঠের পানির গতি-প্রকৃতি খতিয়ে দেখেছেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভূপৃষ্ঠ কিভাবে পাল্টে গেছে, খতিয়ে দেখেছেন তাও। এ জন্য ব্যবহার করেছেন স্যাটেলাইটে তোলা পৃথিবীর ছবি।
তারা দেখেছেন, ১ লাখ ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার (৪৪ হাজার বর্গ মাইল) স্থলভাগ তলিয়ে গেছে পানিতে। আবার ১ লাখ ৭৩ হাজার বর্গকিলোমিটার (৬৭ হাজার বর্গমাইল) জলভাগ রূপ নিয়েছে স্থলভাগে। সবচেয়ে বেশি পনি বেড়েছে তীব্বতীয় মালভূমিতে। আর স্থলভাগের কাছে সবচেয়ে বেশি পানি হারিয়েছে মধ্য এশিয়ার অরাল সমুদ্র। এখন সেটি প্রায় শুকিয়ে গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর সব উপকূলীয় এলাকার চিত্রও পাল্টে গেছে ব্যাপকভাবে। পিছু হটে গেছে জলভাগ, ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই বের হয়ে এসেছে মাটি। অন্য কথায়, স্থলভাগের আয়তন বেড়ে গেছে। আর তার পরিমান অনেক, এক-দুই বর্গকিলোমিটার নয়, হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার।
এ ব্যাপারে গবেষণা চালায় নেদারল্যান্ডসের ডেল্টার্স রিসার্চ ইনসস্টিটিউট। গবেষণা লব্ধ ফলাফল প্রকাশিত হয় জার্নাল নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জে। নাসার ল্যান্ডস্যাট স্যাটেলাইলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবিগুলো বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেন দশকের পর দশক ধরে। ছবিগুলো তোলা হয় ত্রিশ মাইল উপর থেকে।
তাতে দেখা যায়, বিশাল স্থলভাগ এখন তলিয়ে গেছে পানিতে। এই পানির কাছে সবচেয়ে বেশি জমি হারিয়েছে তিব্বতীয় মালভূমি অঞ্চল। বরফ গলে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে বহু জলাধার, লেক ইত্যাদি।
বহু স্থানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখা হয়েছে কৃত্রিমভাবে। ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে অনেক বাঁধের অস্তিত্বের কখা জানা সম্ভব হয়েছে। অথচ এগুলোর কথা জানা সম্ভব হয়নি পৃথিবীবাসীর, এমন কি, প্রতিবেশী দেশেরও।
এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে ডেল্টার্সের ড. ফেডর বার্ট বলছেন, ‘আমরা এমন সব এলাকা খতিয়ে দেখা শুরু করেছি, যার কথা মনচিত্রে পর্যন্ত উল্লেখ নেই।’
আমরা জানি যে মায়ানমারে কয়েকটি বাধ নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। আগে বলতে না পারলেও এখন বলে দিতে পারি যে কয়টি এবং কোথায় কোথায় বাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। উত্তর কোরিয়াও বাঁধ নির্মাণ করেছে এবং করছে। কয়েকটি তো একেবারে দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্ত ঘেঁষে বললেন তিনি।
এর উল্টা ঘটনা অর্থাৎ পানি সরে গিয়ে ভূপৃষ্ঠ বেরিয়ে এসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। আয়তনের দিক দিয়ে এসব এলাকার মোট পরিমান পানির দখল করে নেওয়া স্থলভাগের চেয়ে হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার বেশি।
সবচেয়ে বেশি পানি হারিয়েছে মধ্য এশিয়ার অরাল সমুদ্র। এক সময় এটি ছিল বিশে^র বৃহত্তম লেক। অথচ এখন প্রায় শুকিয়ে গেছে। পানি বলতে গেলে একেবারে নেই। কৃষি কাজের জন্য বিভিন্ন নদী দিয়ে পানি বের করে নিয়ে যাওয়ায় সাগরটির এই অবস্থা হয়েছে বলে জানান গবেষকরা।
লাস ভেগাসের কাছাকাছি অবস্থিত লেক মিডেরও পনি কমে গেছে ব্যাপকভাবে। লেকটির ২২২ বর্গ কিলোমিটার (৮৫ বর্গ মাইল) এলাকা এখন স্থলভূমি। যুক্তরাষ্ট্রের মিঠাপানির সবচেয়ে বড় উৎস এই লেক।
উপকূলীয় এলাকা নিয়েও বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। বৈশি^ক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় এলাকা পানিতে প্লাবিত হওয়ার কথা। কিন্তু ঘটেছে একেবারে উল্টো ঘটনা। পানি কমে গেছে সেখানে। শুধু কমা নয়, ব্যাপক আয়তনে ভূপৃষ্ঠ ভেসে উঠেছে পনির তলা থেকে। এর আয়তন ৩৩ হাজার ৭০০ বর্গ কিলোমিটার (১৩ হাজার বর্গমাইল)। অপরদিকে পানিতে ডুবে গেছে ২০ হাজার ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা (৭ হাজার ৮০০ বর্গমাইল) এলাকা।
বিষয়টি বিস্মিত করেছে ড. বার্টকেও, ‘আমরা ভেবেছিলাম উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় এলাকায় পানি বেড়ে যাবে, পিছু হটবে স্থলভাগ। উল্টো পনিই পিছু হটেছে। শুধু একটি কিংবা দু’টি উপকূলে নয় সারা বিশে^ই এমনটি ঘটেছে। এটি আমাদের একেবারে হতবাক করে দিয়েছে।’
সমুদ্রের পানির বৃদ্ধি উচ্চতা বেড়ে গেছে ঠিকই। সেই সঙ্গে বেড়ে গেছে স্থলভাগের আয়তনও,’ ড. বার্টের গলায় বিষ্ময়, কপালে চিন্তার ভাঁজও।
এর মধ্যে দুবাই উপকূল থেকে পানি সরে গেছে সবচেয়ে বেশি। নতুন নতুন দ্বীপ গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে। বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টও গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে পানি পিছু হটে গেছে।
চীনও তাদের গোটা উপকূলকে সজিয়েছে তাদের মতো করে। পিত সাগর থেকে হংকং পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়েছে বহু স্থাপনা।
আমাজন অঞ্চলে জলভাগ ও স্থলভাগের মধ্যে খুব একটা তারতম্য হয়নি। তবে পাল্টে গেছে ভৌগলিক অবস্থান। সেখানকার নদীগুলোর গতি প্রকৃতি পরিবর্তন হওয়ায় ভৌগলিক অবস্থনের পরিবর্তন হয় বলে মনে করছেন ড. বার্ট।
গবেষক দলটি বলছে, এই পরিবর্তনের প্রভাব পৃথিবীতে কতটা ও কীভাবে পড়ে তা দেখার জন্য আরো অনেক কাজ এখনও বাকি আছে।
নিউজ ডেস্ক : :আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৭:৩০ পিএম, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, শুক্রবার
ডিএইচ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur