‘কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দুইজন নিখোঁজ।’ ‘সমুদ্রে প্রাণ হারালেন দুই শিক্ষার্থী।’ ‘সৈকতে ভাঙল স্বামী-স্ত্রীর নতুন সংসার’- এ ধরণের শিরোনামে পত্রিকায় প্রায়ই সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু সমুদ্রস্নানে নেমে যারা প্রাণ হারাতে বসেন, এবং যাদের প্রচেষ্টায় প্রাণ ফিরে পান তাদের খবর কি পত্রিকায় আসে? ‘কতো মানুষ যে বাঁচিয়েছি, সে খবর কেউ ছাপায় না’
কিছুদিন আগের খবর। সুগন্ধা বিচে গোসল করতে নেমে ১০ বছরের এক কিশোরকে জীবিত উদ্ধার করেছে স্থানীয় লাইফ গার্ডরা। টিউব ছাড়া পানিতে নেমে গিয়েছিল সে। পানির উচ্চতা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেসে যায় সে। এরপর লাইফ গার্ডরা সমুদ্রে নেমে কিশোরকে জীবিত উদ্ধার করে। এ খবর কেউ জানেনি, রাখেনি!
অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বললেন কক্সবাজারের লাইফ গার্ড শুক্কুর। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা কত মানুষ বাঁচিয়েছি, সেই খবর কেউ ছাপায় না! কেউ নিখোঁজ হলে, হারিয়ে গেলে আমাদের জিজ্ঞেস করে কোথায় হারিয়েছে, কখন হারিয়েছে, আমরা কি করছিলাম! কিন্তু আমরা কত কষ্ট করে সমুদ্রে সাঁতরে মানুষ উদ্ধার করি সেটা কখনোই কেউ জিজ্ঞেস করে না!’
কথা শেষে শুক্কুরের হৃদয়ের গভীর থেকে যেন একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার দৃষ্টি তখন গভীর সমুদ্রে। শুক্কুর পুনরায় বলতে শুরু করেন- ‘আমাদের এখানে এসে কেউ হারিয়ে গেলে আমরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাই। তাদের পরিবারের আর্তনাদ, কষ্ট আমরা বুঝতে পারি। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সমুদ্রে থেকে মানুষের উপর নজর রাখি। কিন্তু কেউ যদি আমাদের চোখের সামনে হারিয়ে যায় তাহলে আমাদের কষ্টের শেষ থাকে না।’
কক্সবাজারের লাবণী ও সুগন্ধা পয়েন্টে প্রতিদিন ২০ জন লাইফ গার্ড সেবা দিয়ে আসছেন। দুই শিফটে তারা কাজ করেন। একেক জন আট ঘণ্টা করে দায়িত্ব পালন করেন। সকাল ৭টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন তারা। সেন্ট্রাল ফর ইনজুরি প্রিভেনশন রিসার্চ অফ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এর তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার বিচে সেবা দিয়ে আসছেন তারা। তাদের অর্থায়ন করছে রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফ ইনিস্টিটিউট (আরএনএলআই)। মূলত কক্সবাজার সমুদ সৈকতের কাজটি করে আসছে সিআইপিআরবি।
২০১১ সাল থেকে সিআইপিআরবি বিচে কাজ শুরু করে। দুই বছর ট্রেনিং করানোর পর একজন লাইফ গার্ডকে এক বছর ভলেন্টিয়ার হিসেবে কাজ করতে হয়। এরপর সমুদ্রে নামার অনুমতি পান তিনি। এই এনজিও থেকে মাসিকভিত্তিতে সম্মানী দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন শুক্কুর। সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সম্মানী পান তারা। কর্মকর্তা হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা সর্বোচ্চ সম্মানী পান।
অন্যান্য দেশের মত শুক্কুরদের অত্যাধুনিক কোনো যন্ত্র নেই। এ মুহুর্তে রয়েছে রেসকিউ টিউব ও রেসকিউ বোট। কেউ সমুদ্র স্নানে নেমে ৩০০ মিটার দূরে চলে গেলে রেসকিউ টিউবে করে তাকে ফিরিয়ে আনা হয়। একটি টিউবে সর্বোচ্চ ২জন উদ্ধার করা সম্ভব। হাজার মিটার দূরে চলে গেলে রেসকিউ বোট ব্যবহার করা হয়। বোটের দুই দিকে মিলিয়ে ৬-৮ জন এক সময়ে উদ্ধার করা যায়।
শুক্কুর জানালেন মানুষ উদ্ধারের পর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থাও করেন তারা। ‘চেস্ট প্রেসিং, মাউথ ওপেনিং’- অর্থাৎ বুকে চাপ দিয়ে মুখ খুলে পানি বের করার সহজ প্রক্রিয়া প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শেখানো হয়েছে।
শুক্কুর বলেন, ‘আমাদের এখানে একটা ফর্ম আছে। সেখানে আমরা সব সময় আপডেট রাখি। এখানে কখন, কোথায়, কোন অবস্থায় মানুষ উদ্ধার করি তা উল্লেখ করি। এখন পর্যন্ত আমাদের ফ্লাগের ভিতরে কাউকে আমরা হারাতে দেইনি। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় দেড়শ মানুষকে বাঁচিয়েছি। তাঁদের জীবন বাঁচাতে পেরে আমরা অনেক আনন্দিত। এটাই তো আমার কাজের স্বার্থকতা। ওই পরিবারের কাছে তাদের সদস্যদের ফিরিয়ে দিতে পেরে আমরাই সবচেয়ে বেশি খুশি হই।’
সিআইপিআরবি বর্তমানে শুধু কক্সবাজারে সেবা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে ইনানী বিচ, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ধারাবাহিকভাবে এ সেবা দেওয়া হবে। (রাইজিংবিডি)
নিউজ ডেস্ক :আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৪:০০ পিএম, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, শুক্রবর
ডিএইচ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur