বিএনপিতে ‘বিদ্রোহের’ আভাস । ৫০২ সদস্যের ‘ঢাউস কমিটি’ ঘোষণার পরও পদত্যাগ করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালু সহ মহিউদ্দিন খান মোহন,সালিমুর হক কামাল আরও একাধিক বিএনপিনেতা।আবার অপেক্ষায় আছেন অনেকে। মার্চের বিএনপির জাতীয় সম্মেলনের পর কমিটি করতে দিয়ে ‘অস্বাভাবিক বিলম্ব’ শুরু থেকেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। কাকে রেখে কাকে বাদ দেবেন-এ নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু থেকেই ছিল বিএনপির শীর্ষ পর্যায়েই। প্রায় পাঁচ মাস পর ৫০২ সদস্যের ‘ঢাউস কমিটি’ ঘোষণার পরও দলের ভেতর ক্ষোভ-হতাশা প্রকাশ্যে।
পদ পেয়েও ‘যথাযথ মূল্যায়ন’ না হওয়ায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ নেতাদের একা। কেউ কেউ আবার ক্ষুব্ধ না পেয়ে। নজিরবিহীনভাবে নিজ দলকেই ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’, ‘অসৎ এর খপ্পরে’ বলছেন কেউ কেউ।
এরই মধ্যে পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন দুইজন। এদের একজন আবার খালেদা জিয়ার খুবই আস্থাভাজন মোসাদ্দেক আলী ফালু। পদ ছাড়ার চিন্তাভাবনা করছেন আরও অনেক শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতা। একজন আবার রাজনীতি ছাড়ার পরিকল্পনার কথাও বলেছেন। সব মিলিয়ে কমিটি ঘোষণার পর বিএনপিতে হ য ব র ল অবস্থা।
শেষ পর্যন্ত এসব নেতারা পদ থেকে সরে দাঁড়ালে অথবা দল ছেড়ে দিলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর কমিটি নিয়ে শুধু কেন্দ্র নয়, তৃণমূলের অনেক জায়গায় নেতাকর্মীদের ক্ষুব্ধ মনোভাব প্রকাশ করছেন।
কমিটিতে এমন অবস্থা সৃষ্টির জন্য বঞ্চিত ও অবমূল্যায়িত নেতা এবং তাদের অনুসারিরা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও খালেদা জিয়ার একজন কর্মকর্তার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। কমিটি নিয়ে বড় ধরনের বিদ্রোহেরও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
যদিও বিএনপির নতুন কমিটির মহাসচিবসহ নীতি নির্ধারণী ফোরামের নেতারা বলছেন, বড় দলে কমিটি হলে সবাইকে জায়গা দেয়া যায় না। আন্দোলন সংগ্রামে অবদান বিবেচনা করে কমিটি দেয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
যেসব নেতা পদ ছাড়ার হুমকি দিচ্ছেন তারা শেষ পর্যন্ত চিন্তা থেকে সরে আসবেন এমনটাও মনে করছেন শীর্ষ নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা যারা রাজনীতি করি তাদের মূল শক্তি হলো দল। তাই পদ না পাওয়ার কারণে কেউ দল ছেড়ে যাবেন এমনটা মনে হয় না। কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।’
অভিযোগ উঠেছে, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান ও সাদেক হোসেন খোকা বলয়কে কোনঠাসা করা হয়েছে নতুন কমিটিতে। শুধু তাই নয়, ৯০ এর ছাত্র আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক আমানউল্লাহ আমানদেরও অনেকটা দূরে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে কারণে এসব নেতাদের পাশাপাশি তাদের অনুসারিরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
নতুন কমিটিতে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতামতকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
দলের ভেতর মান অভিমান আর বিরোধের কারণে নানা সময় বিএনপিতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এক এগারের আগে এমন ভাঙনে বিএনপির যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পূরণ হয়নি বলেই মনে করেন দলের নেতারা। এই পরিস্থিতিতে দলে পদ পদবী নিয়ে মনোমালিন্য দলকে আবার নতুন কোনো বেদায়দায় ফেলে দেয় কি না তা নিয়ে সংশয় আর গোপন নয় বিএনপিতে।
কমিটি ঘোষণার পর যা হচ্ছে
গত শনিবার ৫০২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা দেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল। তার ভাষায় এটা ‘ভাইব্রেন্ট ও ডাইনামিক’ কমিটি হয়েছে এবং তার ভাষায় এই কমিটি ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
কিন্তু ফখরুলের কমিটির ঘোষণা আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে থাইল্যান্ড থেকে ফ্যাক্সবার্তায় ভাইস চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার কথা জানান মোসাদ্দেক আলী ফালু। এর কিছুক্ষণ পর সহ-প্রচার সম্পাদকের পদ ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন শামীমুর রহমান শামীম। ইতিমধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান পদ ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, উপদেষ্টা গোলাম আকবর খন্দকারও পদ ছাড়তে পারেন।
দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নতুন কমিটিতে যেই জায়গায় রাখা হয়েছে তা নিয়ে নাখোশ। তবে ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সম্পাদক ও নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছেন এমন অনেকে নিজেদের পদ নিয়ে সন্তুষ্ট নন।
সিনিয়র নেতারা ভেতরে ভেতরে নিজেরা অপমান বোধ করলেও মধ্যম সারির নেতাদের ক্ষোভ উপচে পড়ছে। কেউ কেউ গণমাধ্যমে এ নিয়ে মুখ খুলছেন। নিজে থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ারও কথা বলছেন। এদের বেশির ভাগকেই নতুন কমিটিতে অবনমন করা হয়েছে।
দলের ভেতরের সূত্র বলছে, বঞ্চিত ও অবমূল্যায়নের দাবি করা নেতারা ইতিমধ্যে নিজেদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করছেন। পরবর্তী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করেছেন। নিজে থেকে নিষ্ক্রিয় হওয়ার কথাও বলছেন অনেকে।
এসব নিয়ে গণমাধ্যমে খবর হওয়ায় যাদের পদোন্নতি পাওয়া নেতারাও বিব্রতকর অবস্থার মুখে পড়েছেন।
এদিকে কমিটি ঘোষণার পর প্রথমবারের মতো সোমবার রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কয়েকজন স্থায়ী কমিটির সদস্য সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। তারাও চেয়ারপারসনকে এসব বিষয় অবহিত করেছেন। শিগগিরই স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকে এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে বলে তাদের জানানো হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
অন্যদিকে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থেকে যোগ্যদের বিএনপিতে পদ দেয়ার ঘোষণা থাকলেও কমিটিতে তার খুব বেশি প্রভাব পড়েনি বলে অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রদল, যুবদল থেকে অনেকে পদ পেলেও স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে মাত্র কয়েকজনকে পদ দেয়ায় সংগঠনটির নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্বেচ্ছাসেবক দলের দপ্তর সম্পাদক আকতারুজ্জামান বাচ্চু ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে বিএনপির হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, ‘অপরাপর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা পেলেন, কিন্ত দলে ত্যাগ থাকা সত্বেও যেসব স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা বিএনপিতে স্থান পেলেন না, তারা কী করবেন। সারাদেশের নেতা-কর্মীদের অনুভুতিতে আঘাত পেয়েছেন, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তা প্রশমনের উদ্যোগ দলের হাইকমান্ড নেবেন কি?’
ক্ষোভ আছে বিএনপির নারী কর্মীদেরও। সাবেক ছাত্রনেত্রী, সংসদ সদস্যদের মধ্যেও অনেকে ভালো পদ পায়নি। অনেককে আগের পদেই রাখা হয়েছে। অন্যদিকে আন্দোলন সংগ্রামে তো দূরের কথা দলের কোনো পর্যায়ে কর্মকাণ্ড না থাকলেও ব্যক্তিগত পছন্দে নারীদের অনেকে পদ পেয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মহিলা দলের ঢাকা মহানগরের একজন প্রথম সারির নেতা প্রতিনিধিকে বলেন, ‘গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মেয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়। কিন্তু তার ছেলের বউ তো রমজানে ইফতার পার্টিতে সেজেগুজে যেতো। সেও এখন নির্বাহী কমিটির সদস্য। আর কিছু বলার নেই।’
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন সংস্কারপন্থিরাও
নতুন কমিটি নিয়ে বিএনপির কর্মকাণ্ডের বাইরে থাকা সংস্কারপন্থিরা মধ্যেও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কারণ দল থেকে তাদের বিষয় মূল্যায়ন করা হবে এমন আশ্বাস দেয়া হলেও তাদের কমিটিতে রাখা হয়নি। এ কারণে তারাও নতুন করে চিন্তা ভাবনা শুরু করেছেন।
শুধু তাই নয়, সংস্কারবাদের তকমা পাওয়ার পরও যারা বিএনপিতে ফিরতে পেরেছিলেন তাদেরও কমিটিতে ভালো অবস্থানে রাখা হয়নি বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
তাদের যুক্তি, গত দশম সংসদ নির্বাচনে সরকারের পক্ষ থেকে অংশ নেয়ার জন্য চেষ্টা থাকলেও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের আশ্বাসে সংস্কারপন্থিরা সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ওই সময় বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে সাদেক হোসেন খোকা ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে বৈঠক করে দলে নেয়ার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু কমিটিতে আশ্বাসের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।
সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কমিটিতে রাখা হয়নি। তাই আমরা এখন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছি। আর মানুষতে রাজনীতির বাইরে থাকতে পারে না।’
অন্য একজন সংস্কারবাদী নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিনিধিকে বলেন, বিএনপির সামনে সুযোগ ছিল আমাদের দলে অন্তর্ভূক্ত করার। কিন্তু তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সুযোগ হাতছাড়া করলো।’
ক্ষোভ আমলে নিচ্ছে না বিএনপি
কমিটিতে অবমূল্যায়নের অভিযোগ ও ক্ষোভকে আমলে না নেয়ার কথা জানিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, কমিটির হওয়ার পর এমন ঘটনা স্বাভাবিক। কিছুপর সব ঠিক হয়ে যাবে। যদিও কেউ কেউ কমিটি নিয়ে এমন অভিযোগ নিয়ে ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করছেন।
সোমবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের এ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘বড় দলে অনেক যোগ্য লোক থাকে। কিন্তু সবাইকে জায়গা দেয়া সম্ভব হয় না। যারা বঞ্চিত হয়েছেন তাদের উচিত হবে আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত অপেক্ষা করা। কমিটি পুনর্বিবেচনার সুযোগ নেই।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রতিনিধিকে বলেন, ‘সবদিক বিবেচনা করলে ভালো কমিটি হয়েছে। তাই এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করার সুযোগ নেই। দলে অবদান অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হয়েছে। ’(ঢাকাটাইমস)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৬:১৩ পি,এম ১১ আগস্ট ২০১৬,বৃহস্পতিবার
ইব্রাহীম জুয়েল