বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, খাদ্য নিরাপত্তা, অভিবাসন সংকট মোকাবেলা ও সচেতনতা বাড়াতে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে গণমাধ্যম। ব্যর্থ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২১) ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড অব এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট (আইএফএডি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে গণমাধ্যমকে এভাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
আইএফএডি প্রতিবেদনে বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি গণমাধ্যম। বিশ্বের অন্যতম বড় এই সংকটের কারণ চিহ্নিত করায় তাদের কোনোই ভূমিকা ছিল না। জলবায়ু পরিবর্তন যে কেবল একটি পরিবর্তনই নয়, এটা যে একটি ধ্বংসলীলা, এটা বিশ্ববাসীকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।
এর ফলে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা কতটা হুমকিতে পড়বে, অভিবাসন ও শরণার্থী সংকট বিশ্বকে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে, এ বিষয়টিও যথাযথভাবে তুলে ধরেনি গণমাধ্যম।
শুক্রবার (০৪ ডিসেম্বর) প্যারিসে প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে আইএফএডি’র প্রেসিডেন্ট ক্যানাও এফ নেওয়াজে বলেন, আমরা জানি শুধু গণমাধ্যমই জাতীয় বা আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার কথা জণগণকে জানাতে পারে। ফলে বিষয়টি নিয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা করেছি।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য নিরাপত্তা চেইন ভেঙে যাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বসতবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হওয়া ও বৈশ্বয়িক মানবিক সংকটগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে গণমাধ্যম অগ্রণি ভূমিকা পালন করতে পারে। আর সেটি সম্ভব হলে সংকট সমাধানের কৌশল নির্ধারণ ও বিনিয়োগের উৎস ঠিক করতে আমাদের সুবিধা হবে।
‘ফুড, মাইগ্রেশন অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ: দি আনটোল্ড স্টোরি’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে কিষনিস মিডিয়া লিমিটেডের পরিচালক সাংবাদিক স্যাম ডাবার্লি বলেন, গত সেপ্টেম্বরে এ গবেষণা শুরু হয়। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় আটটি গণমাধ্যমকে এই গবেষণার অংশ হিসেবে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এগুলো হলো- বিবিসি, চ্যানেল ফোর, টিএফ ওয়ান, দি গার্ডিয়ান, ডেইলি মেইল, লে মনডে, লিবারেশন ও ফ্রেন্স টুডে।
ডাবার্লি বলেন, যেহেতু প্যারিসে কপ-২১ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাই আমরা এবার ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের নিউজ আউটলেটগুলোতে সেপ্টেম্বর থেকে নজরদারি করেছি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্ব মিডিয়ার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু তারা সুদখোর ব্যবসায়ী ও নষ্ট রাজনীতিবিদদের পক্ষ নিয়ে কেবল ব্যবসা আর যুদ্ধের সংবাদ প্রকাশ করছে। অথচ তাদের উচিত জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক চিহ্নিত করা, এর সঙ্গে কৃষি, অভিবাসন, খাদ্য নিরাপত্তার সংযোগগুলো তুলে ধরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগে সবাইকে উৎসাহিত করা।
স্যাম ডার্বার্লি তার বক্তব্যে বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমরা টিভি বা সংবাদপত্রে কোথাও জলবায়ু পরিবর্তনের খবর লিড হতে দেখিনি। অবশ্য গণমাধ্যম লিড হওয়ার মতো কোনো সংবাদ পরিবেশনে বিনিয়োগেও উৎসাহ দেখায়নি। সবাই নিয়মিত সংবাদের মধ্যে স্বল্প পরিসরে এই সংবাদের স্থান দিয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, সেপ্টেম্বর থেকেই গণমাধ্যমের মনোযোগ দখলে রেখেছিলো সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। কপ-২১ সম্মেলন নিয়ে তাদের কোনো পরিকল্পনা এবং পরিবেশনা ছিল না। কৃষি নিয়ে কোনো প্রতিবেদন ছিল না, জলবায়ু সংকট ও ভবিষ্যতে শরণার্থী সংকট নিয়েও কোনো খবর প্রকাশ করেনি তারা।
গবেষণায় দাবি করা হয়, ‘মানুষ মনে করতে পারে না গণমাধ্যমে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা সম্পর্কে কী জেনেছে? পত্রিকাগুলোতে এ সংক্রান্ত সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশ হওয়ার কথাও তারা মনে করতে পারে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে ফুড সিকিউরিটি নষ্ট হওয়া বা কৃষির দুর্দিনের সংবাদও প্রকাশ হয়নি। ক্ষুধা, মন্দা, জলোচ্ছ্বাস, ঝড়, বন্যা, খরা, ভূমিধস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির কারণ সম্পর্কেও গণমাধ্যম বিস্তারিত খবর প্রকাশ করেনি।’
গণমাধ্যমের এ বিষয়ক কোনো সম্পাদকীয় নীতিও নেই। অথচ পৃথিবী ধ্বংস হলে তাদের পাঠক বা দর্শক কেউই রক্ষা পাবে না বলেও গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়।
আইএফএডি প্রেসিডেন্ট ক্যানাও এফ নেওয়াজে আরও বলেন, গবেষণায় উঠে এসেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর তিন জনের মধ্যে একজন শহরে বাস করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ওই একজন কৃষি পেশা ছেড়ে শহরে ঠাঁই নিয়েছেন।
তিনি বলেন, কেবল উল্লিখিত আটটি গণমাধ্যই নয়, আমরা সারা বছর ১৯টি আর্ন্তজাতিক ও আঞ্চলকি বৃহৎ ও প্রভাবশালী গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ করে সত্যিই হতাশ হয়েছি। তারা দারিদ্র্য, গৃহহীন, অসহায় মানুষ, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কিছুই ভাবে না। গণমাধ্যমের উপস্থিতি সব সময়ই যেন ‘সার্কাসের সং’য়ের মতো। অথচ তাদের সমাজের আয়না বলা হয়।
গণমাধ্যমকে তাদের আসল ভূমিকা পালন করে গণমানুষের কল্যাণে বিনিয়োগ বাড়াতেও আহ্বান জানান ক্যানাও এফ।