চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের ওয়াকফ পটভূমি মূলত: আহমদ আলী পাটোয়ারী রহ.এর দানশীলতা ও ধর্মীয় চেতনা থেকে উদ্ভূত। প্রতিষ্ঠাতা ও ওয়াকীফ আলহাজ্ব আহমদ আলী পাটোয়ারী রহ.১৩২৫ বঙ্গাব্দ এর ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ দিকে মসজিদটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনিই এ মসজিদের জন্য বিশাল সম্পত্তি ওয়াকফ করেন। এ ওয়াকফকৃত জমিতেই পরবর্তীতে হাজীগঞ্জ এতিহাসিক বড় মসজিদ কমপ্লেক্সটি হিসেবে গড়ে ওঠে।
প্রাথমিক অবস্থায় জানা যায়- বর্তমান বড় মসজিদের মেহরাব সংলগ্ন স্থানে একসময় একটু উঁচু ভূমি ছিল। যেখানে হযরত মকিমউদ্দিন রহ. ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বসতবাড়ি তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীতে আহমাদ আলী পাটোয়ারী রহ.-এর পূর্বপুরুষ হাজী মুনিরুদ্দিন মনাই হাজী-র প্র-পৌত্র হিসেবে তিনি এ স্থানে একটি পাকা মসজিদ নির্মাণের নিয়ত করেন। মসজিদ নির্মাণে তিনি প্রাথমিকভাবে ১শ বাই ২০ হাত আয়তনের একটি পাকা মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন।
হাজীগঞ্জ বড় মসজিদের ওয়াকফের পটভূমি হল এর প্রতিষ্ঠাতা হাজী আহমদ আলী পাটোয়ারী রহ. মসজিদ নির্মাণের জন্য তাঁর বিশাল সম্পত্তি ওয়াকফ করেন। যা চাঁদপুর জেলার অন্যতম বৃহত্তম ও ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ইবাদতের মারকাজ হিসেবে আজ খ্যাত হাজীগঞ্জ ঐতিহাসকি বড় মসজিদ। হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদটি বর্তমানে চাঁদপুর জেলার একটি প্রাচীন মসজিদও। কেবল প্রাচীনের দিক থেকে নয়-আয়তনের দিক দিয়েও এ মসজিদটি উপমহাদেশের বড় মসজিদ হিসেবে পরিচিতি।
১৩৩৭ বঙ্গাব্দে (১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ) হযরত মাও.আবুল ফারাহ জৈনপুরী রহ. মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বর্তমান অবস্থায় মসজিদটি ২৮ হাজার ৪শ ৫ বর্গফুট ভূমির উপরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। আহমাদ আলী পাটোয়ারী রহ. ওয়াকফকৃত এ সম্পত্তির ভেতরেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ আহমদিয়া দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা, মাজিদিয়া কাওমী মাদ্রসা, মনিরুদ্দিন মনাই হাজী হাফেজিয়া মাদ্রাসা,মুনিরিয়া নূরানী মাদ্রসা ও ওয়াকফ এস্টেটের আওতাধীন এ সব মিলেই আজকের সুপরিচিত ‘ হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ কমপ্লেক্স।’
হাজীগঞ্জ বড় মসজিদের ওয়াকফ পটভূমির পেক্ষাপট মতে -আলহাজ্ব আহমাদ আলী পাটোয়ারী রহ. কর্তৃক ধর্মীয় উদ্দেশ্যে জমি দান এবং তাঁর দূরদর্শিতায় দেশের একটি বৃহৎ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ ও ওয়াকফ এস্টেট গড়ে তোলার ইতিহাস সৃষ্টি হলো।
দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ কমপ্লেক্স এর প্রকাশিত ও ড.মোহাম্মদ আলমগীর কবির পাটোয়ারীর সম্পাদিত রচিত গ্রন্থ থেকে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জানা গেছে- সম্ভবত: ১৯৩৩-’৩৪ সালে চাঁদপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক হিসাবে আজিজ আহমেদ বদলি হয়ে যোগদান করেন ।
তিনি মসজিদ পরিদর্শনে আসলে হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের অভ্যন্তরে স্থানীয় কতিপয় লোকের দলাদলি ও ষড়যন্ত্রের কিছ’টা আঁচ করতে পেরেছেন। তিনি চাঁদপুর ফিরে গিয়ে হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের জন্য একটি বিধিমালা তৈরি করে আদেশ জারি করেন। ঐ নীতিমালার মধ্যে প্রধানত: ছিল -জমিদাতা বা সম্পত্তির মালিক হিসেবে বর্তমান মোতওয়াল্লী বা তাঁর উত্তরাধিকারী এ মসজিদের চিরস্থায়ী মোতওয়াল্লী থাকবেন, মোতওয়াল্লীকে একটি ওয়াকফনামা রেজিস্ট্রি করে দিতে হবে এবং একটি কমিটি গঠনের নিদের্শেনা দেন। কথায় আছে-হাকিম নড়লেও হুকুম লড়েনা। ফলে নিদের্শনা মতেই তিনি এগিয়ে যান।
মহকুমা প্রশাসক চাঁদপুর কর্তৃক ৩ এপ্রিল ১৯৩৫ ও ২৭ এপ্রিল ১৯৩৫ আরোপিত নিয়মাবলীর প্রেক্ষিতে মসজিদের কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। পরবর্তীতে মহকুমা প্রশাসকের পরামর্শ বাস্তবায়নে আহমাদ আলী পাটওয়ারী তাঁর মালিকানাধীন সম্পত্তি ওয়াকফ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বর্তমান এবং ভবিষ্যতে অযাচিত এবং বেআইনি হস্তক্ষেপ থেকে উক্ত এস্টেটকে রক্ষা এবং সুন্দরভাবে পরিচালিত হওয়ার লক্ষ্যে কোনো ধরনের অসুবিধা যেন না হয়- সেজন্য সে মোতাবেক পরামর্শ প্রদান করেন।
মোতওয়াল্লীর কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ বা উক্ত পদ নিয়ে কোন্দল বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি যেন না হয়- সে জন্য সৎ. যোগ্য একক ব্যক্তির নেতৃত্বে নিষ্কণ্টকভাবে ওয়াকফ এস্টেট তথা বৃহত্তর এ মসজিদ পরিচালিত হওয়া মনে করেন। তাই ১৯৩৬ সালের ২১ জানুয়ারি আহমাদ আলী পাটওয়ারী রহ.তাঁর মালিকানাধীন নিজ ভূমি বা সম্পত্তি আল্লাহর নামে ওয়াকফ দলিল করেন। জমির পরিমাণ ছিল-১ একর ১৯ শতাংশ। এ দলিল নামা তিনি নিজে ১৯৩৪ সালের বঙ্গীয় ওয়াকফ আইনের ৪৪ ধারা মতে ওয়াকফ তালিকাভুক্ত করার আবেদন করেন। সেই আবেদন তিনি তৎকালীন সময়ে শ্রীযুক্ত বঙ্গীয় ওয়াকফ কমিশনার বরাবরে রাইটার্স বিল্ডিং, কলিকাতা প্রেরণ করেন বা জমা দেন। ‘ আবেদন কারীর নাম ছিল- আহমাদ আলী পাটওয়ারী, পিতা-মৃত আহসান উল্লাহ পাটওয়ারী, সাকিন বা গ্রাম-মকিমাবাদ, পোস্ট : হাজীগঞ্জ ও জেলা-ত্রিপুরা।’

ফলে আহমাদ আলী পাটওয়ারী রহ. হলেন- মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা, ওয়াকফ এস্টেটের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াকীফ ও প্রতিষ্ঠাতা মোতওয়াল্লী। পূর্ববর্তী সময় ব্যতীত তিনি ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মোতওয়াল্লীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে প্রাথমিক ধারণা মতে ১০৭ বছর বয়সে হাজীগঞ্জের এ খোদাভীরু ও সমাজসেবক আলহাজ আহমাদ আলী পাটওয়ারী রহ. মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সমাধিস্থল মসজিদের দক্ষিণ পার্শস্থ সাদা ধবধবে ইটের ঘেরা দেয়ালের ভেতর।
তাঁর মৃত্যুর ৪ বছর আগেই ১৯৬৪ সালে তিনি ওয়াকফ এস্টেটের বিধান মতে পরবর্তী মোতওয়াল্লী নির্বাচন করে তা সম্পাদন করেন এবং দায়িত্ব অর্পণ করেন তাঁরই যোগ্য উত্তসূরি প্রতিভাবান, সৎ, নির্ভীক,কর্মঠ ও আদর্শবান ব্যাক্তিত্ব জ্যেষ্ঠ্যপুত্র মনিরুজ্জামান পাটওয়ারীর উপর। তিনি পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মসজিদসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা ও হাজীগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ীদের উন্নয়নে নানাবিধ কাজ করেন। তিনি ছিলেন এস্টেটের ২য় মোতাওয়াল্লী।
১৯৮৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করার পর আর এক দিকপালকে এস্টেট ও হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক মসজিদ পরিচালনার দায়িত্বভার কাধে তুলে দেয়া হয়। তিনি হলেন তাঁরই জ্যেষ্ঠ্যপুত্র আধুনিক হাজীগঞ্জের রূপকার হিসেবে পরিচিত, বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ড.আলমগীর কবির পাটওয়ারী।
ফলে তিনি এস্টেটের ৩য় মোতাওয়াল্লী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি এসে আহমাদিয়া কামিল মাদ্রাসা, জামিয়া আহমাদিয়া কাওমী মাদ্রাসা ও নূরানী-হাফেজিয়া মাদ্রাসার উন্নয়নসহ মসজিদের আয়বর্ধনমূলক ব্যাপক প্রকল্পগ্রহণ করেন। মসজিদ ও হাজীগঞ্জের আধুনিকতার রূপদান করার উদ্যোগ নেন তিনি। শিক্ষা-দীক্ষা-কর্মসংস্থানের মাধ্যমে হাজীগঞ্জ তথা বাজার ব্যবসায়ীদের আর্থিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখেন। হাজীগঞ্জের উচ্চতর ও ধর্মীয় শিক্ষায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন অধ্যক্ষ ড. মো.আলমগীর কবির পাটওয়ারী।
বয়স ও সময়ের ব্যবধানে এবং প্রচন্ড কাজের চাপে ২০২০-২১ সালে তিনি এস্টেটের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন- তাঁরই সুযোগ্য সন্তান, সাদামাটা জীবনের অধিকারী, স্বল্পভাষী, আদর্শবান ব্যাক্তিত্ব,কর্মঠ,বিদ্বান ও তরুণ প্রতিভাবান, সমাজবিজ্ঞানী , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের মেধাবী ছাত্র ও ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে ল’ ডিগ্রিধারী আলহাজ¦ প্রিন্স শাকিল আহমেদের উপর। তিনি হলেন এস্টেটের ৪র্থ মোতওয়াল্লী।
তিনি তাঁর পৌঢ়-পিতা হাজী আহমাদ আলী পাটওয়ারী রহ.,পিতামহ আলহাজ¦ মনিরুজ্জামান পাটওয়ারী রহ., পিতা-ড.আলমগীর কবির পাটওয়ারীর আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে শিক্ষাবিদ পিতার উপদেশ,ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ ওয়াকফ বোর্ডের নির্দেশনা মতে-এস্টেট ও হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ কমপ্লে¬ক্স সুচারুরূপে পরিচালনা করছেন। তাঁর অনুজপ্রতীম ছোটভাই ব্যারিস্টার শাহরিয়ার আহমেদও তাঁর পাশে রয়েছেন সার্বক্ষণিক।
এদিকে বিশিষ্ঠ আলেমেদীন আহমেদিয়া কাওমী মাদ্রাসার মোহতামিম ও মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আবদুর রউফ সুদীর্ঘ প্রায় ২৩ বছর ধরে হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিটি জুমায় , জুমাতুল বিদা ও ঈদের জামাতের ইমামতি করেন তিনি।
পেশ ইমাম হিসেবে রয়েছেন আরো দু’জন এবং মোয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন দু-জন। হাফেজ শাহ এমরান ও হাফেজ মো.শামীম আহমেদ। এর মধ্যে প্রায় ২৭ বছর ধরে মসজিদের মোয়াজ্জিন হিসেবে ৫ ওয়াক্ত সুমধুর কণ্ঠে আযান দিচ্ছেন হাফেজ শাহ এমরান। যা দৈনিক প্রায় ২০ টি মাইকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত সাইন্ড সিস্টেমে প্রচারিত হচ্ছে। সব মিলে আহমাদ আলী পাটওয়ারী রহ.ওয়াকফ এস্টেটটি শতাব্দীকাল যাবত হাজীগঞ্জ তথা এ অঞ্চলের ধর্ম-কর্ম, শিক্ষা-দীক্ষা,বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানমুখী সেবা দিয়ে আসছে ।
হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদে হাজার হাজার আলেমে দ্বীন, হাজী সাহেবান,অলি-দরবেশ, বুজুর্গানে দ্বীনিগণের সাথে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ ও জিকির-আজকার.তাসবিহ-তাহলিল এবাদত বন্দেগীর সাথে নিয়মিত জুমা এবং জুমাতুল বিদা নামাজের বিশাল জামাতে শরিক হতে প্রতি জুমায় ও জুমাতুল বিদায় হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান আসেন ।
তথ্য সূত্র : হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ কমপ্লেক্স এর স্মারক গ্রন্থ। লেখক : আবদুল গনি, শিক্ষক প্রাবন্ধিক ও ভার-প্রাপ্ত সম্পাদক, সাপ্তাহিক হাজীগঞ্জ। ১ নভেম্বর ২০২৫ ।
আবদুল গনি
৪ নভেম্বর ২০২৫
এজি
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur