চাঁদপুর পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া কঞ্জারভেন্সী বিভাগের আন্ডার গ্রাউন্ড ড্রেনের কাজ নিয়ে ২৮ লাখ ৭৪ হাজার টাকার ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে শহরবাসীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। লাখ টাকার কাজ হলেও মাঠপর্যায়ে এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, গত কয়েক মাস পূর্বে চাঁদপুর পৌরসভার কঞ্জারভেন্সী শাখা কোন প্রকার টেন্ডার পক্রিয়া বা দরপত্র বিপ্তপ্তি ছাড়াই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ২৮ লাখ ৭৪ হাজার টাকা ব্যয়ে শহরের কয়েকটি এলাকায় আন্ডার গ্রাউন্ড ড্রেনের পরিস্কারের কাজ করেন। আর এর দায়িত্বে ছিলেন কঞ্জারভেন্সী ইন্সপেক্টর মোঃ শাহাজাহান খান। কিন্তু সে কাজ যথাযথ ভাবে না হওয়ার কারনে এবং কাগজে উল্লেখিত সবস্থানে যথাযথ কাজ না করায় বিভিন্ন সড়ক ও এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে দেখা যায়। আর তাতেই প্রশ্ন উঠে পৌরসভার এমন কাজের অনিয়ম নিয়ে। যেখানে প্রাথমিক ভাবে সর্বমোট ২৮ লাখ ৭৪ হাজার টাকা কাজের ব্যয় ধরা হয়েছে। আর সম্পন্ন কাজ সঠিক ভাবে না করেই, নামেমাত্র কয়েকটি স্থানে কোনরকম কাজ করেন তারা। সেখানে কয়েক সপ্তাহ না পেরতেই কেনই বা জলাবদ্ধতা দেখা দিবে? এমনটাই প্রশ্ন সচেতন মহল ও বিভিন্ন এলাকাবাসির।
এছাড়া কাজের দৈনিক হাজিরায় কাগজে কলমে ১২০ জন শ্রমিককে দেখানো হলেও, বাস্তবে কাজ করেছেন ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক। সেটিও করা হয়েছে নিয়ম বর্হিভূত ভাবে। যেখানে পৌরসভার বেতনভুক্ত পরিস্কার পরিছন্নকর্মী রয়েছে। সেখানে কেনইবা এমন মোটা অংকের ব্যয় দেখিয়ে বিল করে বাহিরে থেকে লোক এনে কাজ করাতে হবে…? কাজের শ্রমিক সংখ্যা এবং মিটার অনুযায়ী কাজের তথ্যেও রয়েছি কঞ্জারভেন্সী ইন্সপেক্টর শাহাজাহান খানের লুকোচুরি খেলা।
এ বিষয়ে চাঁদপুর পৌরসভায় কর্মরত একাধিক বিশ্বস্ত ব্যক্তি সূত্রেও এই কাজের চরম অনিয়মের কথা জানা গেছে।
খবর নিয়ে জানা যায়, চাঁদপুর পৌরসভার নথি অনুযায়ী শহরের কয়েকটি এলাকায় আন্ডার গ্রাউন্ড ডেন পরিষ্কার কাজের জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো- মিশন রোড হয়ে আশ্রমের পাশের রাস্তা ও ছৈয়াল বাড়ি রাস্তার আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনের ময়লা পরিষ্কারের প্রাক্কলন ব্যয় ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৬০০ টাকা, চাঁদপুর সরকারি কলেজ হতে নাজির পাড়া হয়ে গাজীবাড়ির রাস্তার আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনের ময়লা পরিষ্কার এর পাক্কলন ব্যয় ৪ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ টাকা, স্টেডিয়াম রোড আবুলের দোকান হতে নাজির পাড়া দেওয়ান বাড়ির রাস্তার আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনের ময়লা পরিষ্কারের প্রাক্কলন ব্যয় ৪ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ টাকা, ঘোষপাড়া ব্রিজ হতে চিত্রলেখা রোড এলাকা আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনের ময়লা পরিষ্কারের প্রাক্কলন ব্যয় ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৮০০ টাকা, চিত্রলেখা রোড হতে বিপুলীবাগ পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনের ময়লা পরিষ্কারের প্রাক্কলন দেয় ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০ টাকা, বিপনীবাগ বাজার হতে ইলিশ চত্বর পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনের ময়লা পরিষ্কারের প্রাক্কলন ব্যয় ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৬০০ টাকা এবং পুরান বাজার চৌধুরী বাড়ি ও পাটোয়ারী বাড়ির সামনের খাল পরিষ্কার বাবদ প্রাকলন দেয় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬০০ টাকা। এভাবে সর্বমোট ২৮ হাজার ৭৪ লাখ টাকার ব্যয় দেখিয়ে চাঁদপুর পৌরসভার কঞ্জারভেন্সী শাখা বিল পাশ করেন। এতে নেই কোন টেন্ডার পক্রিয়া।
অথচ পৌরসভার কঞ্জারভেন্সী কাজের বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিটি কাজের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও তদারকির ক্ষেত্রে খোলামেলা নথিপত্র ও দৃশ্যমান মান বজায় রাখার কথা থাকলেও বাস্তবে এর অনেক ব্যত্যয় লক্ষ্য করা গেছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে আন্ডার গ্রাউন্ড ড্রেনের উন্নয়ন কাজ শেষ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন সঠিকভাবে না হওয়ায় বৃষ্টির পানি জমে নাগরিকদের ভোগান্তি বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের সরকারি ক্রয় আইন (Public Procurement Act – PPA) ২০০৬ এবং সরকারি ক্রয় বিধিমালা (Public Procurement Rules – PPR) ২০০৮ অনুযায়ী, ২৫ হাজার টাকার বেশি ব্যয়ের যেকোনো সরকারি কাজ অবশ্যই টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার ছাড়া কোনো কাজ সম্পাদন করা হলে সেটি আইন লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া, বছরে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকার কাজ পৌরসভা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে চাঁদপুর পৌরসভা এসব আইন ও বিধিমালা উপেক্ষা করে কোনো টেন্ডার ছাড়াই এর চেয়ে বহু গুণ বেশি অর্থ ব্যয়ে কাজ বাস্তবায়ন করেছে। সেটাই এখন অনিয়ম ও দুর্ণিতীর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরজমিনেও খবর নিয়ে জানা যায়, শহরের কলেজ গেট, চিত্র লেখা মোড় নাজির পাড়া, বকাউল বাড়ি রোডে কয়েক ঘন্টা টানা বৃষ্টি হলেই এসব এলাকা গুলোতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। চিত্রলেখা, সরকারি কলেজ গেট ও কুমিল্লা রোড এলাকার মোজাম্মেল হক, রশিদ খান, মনির হোসেন, তারিকুর রহমান, হুমায়ন আজাদসহ একাধিক ব্যক্তিরা বলেন, মাত্র এক দেড় মাস পূর্বে পৌরসভা আমাদের এসব এলাকা গুলোতে ড্রেনের পরিস্কারের কাজ করেছে। কয়েক সপ্তাহ না পেরুতেই এখন একটু টানা বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এমন জলাবদ্ধতাই প্রমান করে তারা কতটুকু সঠিক ভাবে কাজ করেছেন। তাছাড়া আমরা দেখেছি যেদিন কাজ হতো সেদিন সর্বমোট ১৫/১৬ জন লোকে কাজ করতো।
নাগরিক সমাজের দাবি, পৌরসভার কঞ্জারভেন্সী কাজের প্রতিটি ধাপ স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করতে হবে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ হলেও যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকে, তবে সেই উন্নয়ন কার্যত ব্যর্থ হয়ে পড়বে।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের দ্রুত তদন্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে সাধারণ মানুষ। পৌরসভার কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করা না গেলে, নাগরিক ভোগান্তি আরও বাড়বে বলেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
আন্ডার গ্রাউন্ড ড্রেনের কাজের দায়িত্বে থাকা চাঁদপুর পৌরসভার কঞ্জারভেন্সী ইন্সপেক্টর মোঃ শাহাজাজান খান জানান, পৌরসভা সব কাজ যথাযথভাবে এবং নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন করেছে। আমরা কোন অনিয়ম করিনি।কি নিয়মে বা কতো শ্রমিক হাজিরায় কাজ হয়েছে এমন কাগজ চাইলে তিনি সময় নিয়ে তিন দিন পর বলেন, আমরা মিটারে কাজ করিয়েছি। চিকন ড্রেনের কাজ মোট ১৪৪৪ মিটার এবং মোটা ড্রেন কুমিল্লা রোডে ১,০০০ মিটার পর্যন্ত করা হয়েছে। যা ঘোষপাড়া থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। চিকন ড্রেনের প্রতি মিটার খরচ ১,০০০ টাকা এবং মোটা ড্রেনের প্রতি মিটার খরচ ১,৩০০ টাকা। সব কাজ চুক্তি অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছে। কাজের বিলের কাগজ চাইলে ইন্সপেক্টর জানান, তা একাউন্টস বিভাগের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
এরপর একাউন্টস বিভাগের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা সৈয়দ মশিউর রহমানের কাছে আন্ডার গ্রাউন্ড ড্রেনের কাজের বিলের কাগজ চাইলে তিনি বলেন, প্রশাসক স্যারের অনুমতি ছাড়া আমি কোনো কাগজ বা তথ্য সরবরাহ করতে পারব না। অনুমতি পেলে তা দেওয়া সম্ভব।
এরপর চাঁদপুর পৌরসভার প্রশাসক গোলাম জাকারিয়ার কাছে মুঠোফোনে বিলের কাগজ চাইলে অপারগতা জানিয়ে বলেন, অফিসাল তথ্য চাওয়া হলে তা সরাসরি দেওয়া যায় না। আপনি তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে আবেদন করলে আমরা বিষয়টি বিবেচনা করব।
তবে প্রশ্ন হলো, যদি কাজের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি না ঘটে এবং সবকিছু স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়, তাহলে কেনো পৌর প্রশাসক স্বয়ং এমন তথ্য দিতে অপারগতা জানাবেন। এতেই বুঝা যায়, কাজের স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতা কতটুকু?এভাবে দেখা যাচ্ছে, পৌরসভা কর্তৃপক্ষ কাজের যথাযথতা দাবি করলেও, তথ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ায় সাধারণ নাগরিককে বেশ সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
প্রতিবেদক: কবির হোসেন মিজি/ ২৫ আগস্ট ২০২৫
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur