কিভাবে গড়ে উঠেছে চাঁদপুর জেলার অন্যতম হাজীগঞ্জ বাজার তার অজানা তথ্য দিলেন সাবেক মেয়র আব্দুল মান্নান খান বাচ্চু। ২১ আগষ্ট বৃহস্পতিবার রাত ৯ টার দিকে তার ফেইসবুক পেইজ থেকে পাওয়া লেখা হুবুহু তুলে ধরা হলো।
এক সময় পাকিস্তান আমলে হাজীগঞ্জের ডাকাতিয়া নদীতে সি প্ল্যান (নদীতে উড়তে পারে নামতে পারে এমন বিমান) পাট কোম্পানির টাকা নিয়ে আসতো ।
(আমরা যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করি তারা বড় লেখা পড়তে চাই না, ইতিহাস জানতে হলে বড় লেখা পড়তে হবে। আর ইতিহাস না জানলে আপনি সঠিক রাজনীতি করতে পারবেন না। আর স্লোগান দিতে পারবেন অমক নেতা জিন্দাবাদ অমুক ভাই এগিয়ে চলো)
হাজীগঞ্জ বাজারের ২০০ বছরের ইতিহাস জানতে হলে আপনাকে এই লেখাটি পড়তে হবে।
পাকিস্তান আমলে হাজীগঞ্জ বাজার ছিল ব্যবসা বাণিজ্যর জন্য বিখ্যাত ও জমজমাট। বড় ব্যবসা কেন্দ্রের জন্য সারা দেশে হাজীগঞ্জ বাজারের ছিল প্রচুর শুনাম। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বড় বড় ব্যবসায়ী এখানে আসতো পাইকারি ভাবে এসব পণ্য ক্রয় করার জন্য – আর সেসব পণ্য হলো পাট, তামাক, সুপারি ও মরিচ । বিশেষ করে সারা দেশে এই ৪টি পণ্যর জন্য ছিল হাজীগঞ্জ বাজার বিখ্যাত।
এখানে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী ধনী ছিল এদের মধ্যে যেই কয়জন বড় ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন তারা হলেন টোরাগড়ের খান সাহেব জুনাব আলি মুন্সী ( মরহুম এম এ মতিন সাহেবের পিতা), জনাব কাজী আলপট মিয়া, জনাব সায়েদ আলী সরকার, রান্ধুনিমুড়ার ছিল হাজী ফজর আলী বেপারী (মেয়র মান্নান খান বাচ্চুর দাদা), জনাব খলিলুর রহমান, হাজী আফিজ উদ্দিন বেপারী, জনাব সেকান্তর আলী মজুমদার এবং হাজী জব্বর আলী মিয়া। রায়চো ছিল হাজী সোনা মিয়া বেপারী, জিতু মিয়া বেপারী। বলাখালে ছিল বাবু বলরাম সাহা, জমিদার যুগেন্দ্র নারায়ন সাহা, বাবু সন্তোষ কুমার সাহা। বড়কুলের ছিল অনাথ পোদ্দার, রূপবাবু সাহা, হিরালাল সাহা, হিতিশ সাহা, প্রাণ বল্লভ সাহা, জীবন বল্লভ সাহা, দারি কানাত সাহা, সিথানাথ কোম্পানি, অনুকূল সাহা, হারান কুণ্ড, পদ্দ ভূষণ সাহা। মকিমাবাদের ছিল বাবু মনোরঞ্জন সাহা, বাবু গ্রিস চন্দ্র সাহা। লাকসামের ছিল বাবু অবয় সাহা, মুন্সিগঞ্জের ছিল ( নামটি এখন সঠিক মনে নাই দুঃখিত)। বর্তমান কাপরিয়া পট্টিতে একমাত্র কাপড়ের বড় ব্যবসায়ী ছিল ভৈরবে বাড়ি নাম বাবু ভৈরব সাহা, দোকানের নাম ছিল ভৈরব বস্রালয় যা এখনো বিদ্যমান । মকিমাবাদ, বড়কুল ও বলাখালে কোন বড় মুসলমান ব্যবসায়ী ছিল না। হলুদপট্টিতে ছিল বাজারের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ীরা আর এই খানেই হতো বাজারের সব পাইকারি বেচা কেনা । হলুদপট্টিকে বলা হতো চট্টগ্রাম এর খাতুনগঞ্জ। এই সব পুরাতন হিন্দু ধনী যারা তারা বেশির ভাগেই ভারতে চলে গেছেন। বাকি স্বল্প যারা আছেন তারা চরম অথনৈতিক দুর অবস্থায় আছেন বর্তমানে। আর এসব পুরাতন মুসলিম ধনীরা কিছু পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে বিলীন হয়ে গেছেন আর বাকি পরিবার কেরোসিনের বাতির মতো জিবন প্রদীপ নিভুপ্রায় অবস্থায় আছেন।
এখানে ছিল পাকিস্তান ও ভারতের বড় বড় কয়েকটি পাট কোম্পানি । এরা হলো পাকিস্তানের ইস্পাহানী কোম্পানি ও ভিরুলা কোম্পানি। ভারতের হলো রেলি ব্রাদার্স। আর পূর্ব পাকিস্তানের ছিল আমিন কোম্পানি। এর মধ্যে পাকিস্তানের কোম্পানি যারা ছিল তারা তাদের জুট মেইলে এসব পাট পাঠাতো। এই জুট মেইল গুলি ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও নারায়ণগঞ্জ। রেলী ব্রাদার্স কোম্পানি তাদের ক্রয় করা পাট নিয়ে যেতো ভারতে। হাজীগঞ্জে টোরাগড় গ্রামে হামিদিয়া জুট মেইল নামে একটি মিল ছিল। এখন সেই মেইলের জায়গা ও গুডাউন সব আছে কিন্তু মিল নাই।
ব্রীজ এর পূর্ব উত্তর পাশে যেই সমিতির গোডাউন আছে এখানে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের একটি টেক্স টাইল মেইল। কিন্তু এখন কার নতুন প্রজন্ম শুনলে আচ্যর্য্য হবেন পাকিস্তানের সেরা শার্টের কাপড় এখানে তৈরি হতো। এই বোয়ালতলী খালের উপরে রেইলের যেই ব্রীজ আছে তার পূর্ব পাড়ে উত্তর পাশে একটি মাঝারি ধরনের টেক্স টাইল মেইল ছিল।
সেই সময় হাজীগঞ্জ বাজারে কোন ব্যাংক ছিল না। এই সব সি প্ল্যান এই ৪ কোম্পানির পাট ক্রয়ের টাকা নিয়ে আসতো। যেহেতু টাকার সংখ্যা এদের অনেক তাই অন্য কোন মারপতে এতো টাকা আনা সম্ভব হতো না। এই সি প্ল্যান প্রথম এসে মনিনাগ সোনাপুর খালের মুখে নামতো সেখান থেকে অতী দ্রুত গতিতে পূর্ব দিকে টোরাগড় নদীর পাড়ে সওদাগর পাড়ায় চলে যেতো। এখান থেকে খুব দ্রুত গতিতে আবার সোনাপুর খালের ঐদিকে চলে যেতো। আবার বাজারের দিকে যেয়ে যেই কোম্পানির টাকা ওই কোম্পানির অফিসের সামনে থাকতো। বিমানটি থাকতো নদীর মাঝে । বেশির ভাগ কোম্পানির অফিস ছিল নদীর পাড়ে। তারপর কোম্পানির লোক নৌকা করে এসে বিমান থেকে টাকা নিয়ে যেতো। প্রায় আধা ঘন্টা বিশ্রাম শেষে আবার চলে যেতো।
তখন কার সময় মানুষের নৌকায় ছিল একমাত্র যানবাহন কেননা তখন তেমন গাড়ি ছিল না। সেই জন্য ডাকাটিয়া নদীতে ছিল অনেক নৌকা। প্ল্যান নামার আগে বাজারের উপর দিয়ে তিন চক্কর দিত। এই তিন চক্কর দেওয়ার কারণ হলো নৌকার মাঝি দেরকে নদীর এক পাশে যেয়ে নিরাপদে থাকার জন্য সংকেত দিত। হাজীগঞ্জের নতুন প্রজন্ম জানে না যে পাকিস্তান আমলে থেকে হাজীগঞ্জের বড় ধনী ছিল কোন কোন পরিবার। আমার এই ক্ষুদ্র লেখা থেকে আসা করি তারা জানতে পারবে।
প্রতিবেদক: জহিরুল ইসলাম জয়, ২১ আগস্ট ২০২৫
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur