আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চাঁদপুরে মতলব উত্তর উপজেলায় এ বছর আখের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে হাসি ফুটে উঠেছে কৃষকের মুখে। দামও ভালো। কৃষকরা নায্যমূল্য পেয়ে দারুণ খুশি। চাঁদপুর গেন্ডারির খ্যাতি দেশজুড়ে রয়েছে। তাই ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে আখ ব্যবসায়ীরা ভিড় করছে।
উপজেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারগুলো খুচরা আখ ব্যবসায়ীদের বেচা-কিনি শুরু করেছে। প্রচন্ড গরমে রসালো এ ফল পেয়ে ক্রেতারা আখের দোকানগুলোতে ভীড় জমাচ্ছে। লোকজন আত্মীয়ের বাড়ি বা নিজের বাড়িতে আখ কিনে নেওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ছে অহরহ।
মতলব উত্তরের কলাকান্দা, জোড়খালি, হানিরপাড়, গজরা, বেগমপুর, নান্দুরকান্দি, ছোট হলদিয়া, বড় হলদিয়া, সরদারকান্দি, হাজীপুর, রাঢ়ীকান্দি, ওটারচর, নিশ্চিন্ত—পুরসহ ক’টি এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকরা এখন আখ তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এমনকি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আখ ব্যবসায়ীরা এসে মিনি ট্রাক ও ট্রলার যোগে আখ নিয়ে যাচ্ছে।
মতলব উত্তর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের ভেতরে প্রায় ২শ’ ২০ হেক্টর উঁচু জমিতে দেশি ও উন্নত জাত মিলিয়ে ৬ জাতের আখ চাষ হয়েছে। সেচ প্রকল্পের উঁচু জমিগুলো পলি ও দোঁ-আশ মাটির পরিমাণ বেশি থাকায় আখের ফলন সবসময় ভালো হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নায্যমূল্য পেয়ে কৃষকরা একদিকে যেমন খুশি তেমনি আখ চাষের দিকে ঝুঁকছে কৃষকরা।
ন্যায্য দাম পেয়ে আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছে কৃষকের মুখে। গোটা দেশজুড়ে আখের বেশ চাহিদা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মতলবের সুস্বাদু ও রসালো এ আখ মিষ্টি বেশি হওয়ায় পাইকাররা নিয়ে যাচ্ছেন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। দেশীয় জাতের আখ (চাঁদপুর গেন্ডারি ও সিও-২০৮ চাষে চাঁদপুর জেলার সুনাম ও সুখ্যাতি বহু বছরের। সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় দেশীয় জাতের সিও ২০৮ ও চাঁদপুর গেন্ডারি। চিবিয়ে খাওয়ার জন্য এ আখ অন্যতম।
মতলব উত্তর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, এ বছর মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের ভিতরে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ২শ’ ২০ হেক্টর নির্ধারণ করা হয়েছিলো। কিন্তু ২০৫ হেক্টর জমিতে আখ আবাদ হয়েছে। গতবছর ১৮০ হেক্টর জমিতে আখ চাষের আবাদ হয়েছে। যার তুলনায় এ বছর ২৫ হেক্টর বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে এ বছর চাঁদপুর গেন্ডারি ৫৫ হেক্টর, সিও-২০৮ হয়েছে ২৫ হেক্টর, বিএসআরআই-৪১ হয়েছে ৫০ হেক্টর, বিএসআরআই-৪২ হয়েছে ৪৫ হেক্টর ও ঈশ্বরদী-৩৪ হয়েছে ৩০ হেক্টর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। ফলন হয়েছে প্রতি হেক্টরে ৬২ টন। সেচ প্রকল্পের উঁচু জমিগুলো পলি ও দোআঁশ মাটির পরিমাণ বেশি থাকায় আখের ফলন প্রতি বছরই ভালো হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মতলব উত্তরের কলাকান্দা ইউনিয়নের হানিরপাড়, দশানী, বালুচর, শিকিরচর, ছোট হলদিয়া, নিশ্চিন্তপুর, নান্দুরকান্দি, লবাইরকান্দি, বড় হলদিয়া, সরদারকান্দি, ওটারটরম হাজীপুর, রাঢ়ীকান্দিসহ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকরা এখন আখ তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকাররা এসে মিনি ট্রাক ও ট্রলারযোগে আখ নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি আখ ২৫-৩০ টাকা দরে কৃষকরা পাইকারি বিক্রি করছেন। ঢাকায় তা পাইকারি ৩৫-৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
ছেংগারচর পৌরসভার বারআনী গ্রামের কৃষক এনায়েত উল্ল্যা (৫৫) জানান, তিনি প্রায় ২২ বছর ধরে আখ চাষ করছেন। এ বছর তিনি ৩০ শতাংশ জমিতে নতুন জাতের রঙ্গ বিলাস আখের চাষ করেছেন। দেশীয় জাতের আখের চাইতে রঙ্গ বিলাস আখের বাজার দর অনেক বেশি। প্রতিটি আখের খুচরা দাম ৫০ টাকা।
কথা হয় ছেংগারচর বাজারে হানিরপর গ্রামের কৃষক মোঃ মোহসিন (৪৫) জানান, তিনি ১৯৯০ সালের পর থেকে আখের আবাদ করছেন। এ বছর তিনি ৩০ শতক জমিতে আখের আবাদ করছেন। তার খরচ হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। আখ তিনি নিজেই ছেংগারচর বাজারে প্রতি পিচ ৪০,৪৫,৫০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। তার খেতে ৭ হাজার পিচ গেন্ডারি রয়েছে। বাজারে ইতিমধ্যে বিক্রি করেছেন ৫০০ পিচ। এ পর্যন্ত তিনি ২৫ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। তার খেতে যে আখ রয়েছে বর্তমানে আখের যে বাজার মূল্য এতে তিনি ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা বিক্রির আশা করছেন তিনি। খরচ উঠিয়ে আমার প্রায় দ্বিগুণ লাভ হবে বলে আশা করছি। গত বছর তার মুনাফা হয়েছিলো ৫০ হাজার টাকা।
রেজউল করীম নামে এক মৌসুমী আখ ব্যবসায়ী জানান তিনি একটি আখ খেত গৃহস্তের কাছ থেকে ৪০ টাকা দিয়ে কিনেছেন।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে পাইকাররা কৃষকের ক্ষেত থেকে আখ কিনে তা শ্রমিক দিয়ে তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শনিবার সরেজমিন উপজেলার হানিরপাড় এলাকায় ঢাকার বেপারী মুক্তার (৪২)সহ আরও কয়েকজন বেপারীকে আখ তুলতে দেখা গেছে।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা পাইকাররা শাহেন শাহ বলেন, এ অঞ্চলের আখ খুব মিষ্টি। ঢাকায় মতলবের আখের খুব চাহিদা। তাই প্রতি বছর আমি এ অঞ্চলে আখ কিনতে আসি। প্রতিটি আখ পাইকারি ৩০-৩৫ টাকা করে ক্রয় করি। ঢাকায় এনে তা’ পাইকারি ৪৫-৬০ টাকা বিক্রি করি। কৃষক আবুল হোসেন বলেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার আখের ফলন ভাল হয়েছে। দামও ভাল। আশা করছি ভালই লাভ হবে।
মতলব উত্তর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফয়সাল মোহাম্মদ আলী জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর আখের বাম্পার ফলন হয়েছে। স্থানীয় চাঁদপুর গেন্ডারি, সিও-২০৮, বিএসআরআই ৪১, বিএসআরআই ৪২ ও ঈশ্বরদী-৩৪ জাতসহ ৫টি জাতের আখ চাষ হয়েছে। বিভিন্ন রোগবালাই থেকে কৃষকরা যেন তাদের ফসল বাঁচাতে পারে সে জন্য যথাসময়ে কৃষি অফিসের মাধ্যমে সঠিক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় আখ চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে।
নিজস্ব প্রতিবেদক/ ১৮ আগস্ট ২০২৫
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur