Home / চাঁদপুর / কোলাহলমুখর চাঁদপুর ইচলী ফেরিঘাট আজ নিস্তব্ধ, বিলীন
ইচলী

কোলাহলমুখর চাঁদপুর ইচলী ফেরিঘাট আজ নিস্তব্ধ, বিলীন

চাঁদপুরের মানুষের স্মৃতি আর জেলার শতবর্ষী ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকা এক নাম, ইচলী ফেরিঘাট। দেশের বৃহত্তম নদীবন্দর সদরঘাটের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এই ঘাট। সময়ের বিবর্তন আর অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে সেই এক সময়ের কোলাহলমুখর ইচলী ফেরিঘাট আজ প্রায় নিস্তব্ধ, বিলীন ।

একসময় রামগঞ্জ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীসহ দক্ষিন পূর্বাঞ্চলের আশপাশের কয়েক জেলার হাজার হাজার মানুষ এই ঘাট দিয়েই লঞ্চে চড়ে ঢাকায় যেত। সদরঘাট থেকে ফিরে এসেও পা রাখতো এই ঘাটে। দিনরাত চলত মানুষের ভিড়, লঞ্চের হুইসেল, নৌকার মাঝিদের ডাকাডাকি আর টোলের ব্যস্ততা।
এই ফেরিঘাটের বুকেই গড়ে উঠেছিল অসংখ্য মানুষের জীবিকার উৎস, খেয়া নৌকা, দোকান, খাবারের হোটেল আর টোল আদায়ের ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে এ ঘাট ছিল এক জীবন্ত নদীজীবন ও ব্যবসার কেন্দ্র।

২০০৫ সালে চাঁদপুর-রায়পুর সেতু চালু হওয়ার পর থেকেই কমতে থাকে ফেরিঘাটের কোলাহল, মানুষের সমাগম। বন্ধ হয়ে যায় ফেরি চলাচল। তবু লঞ্চঘাটের কারণে তখনো টিকে ছিল মানুষের যাতায়াত, আশপাশের মানুষ তখনো সংক্ষিপ্ত নদীপথে শহরে যেত-আসত।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চ চলাচলও কমে আসে, এখন আর কোনো লঞ্চ ইচলী ঘাটে ভিড়ে না। ফলে ইচলী ফেরিঘাট হারিয়েছে তার মূল প্রাণশক্তি, আর হয়ে গেছে প্রায় জনশূন্য এক স্থান।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এক সময় যেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষের ভিড়, যানবাহনের দীর্ঘ লাইন আর লঞ্চের হুইসেলে সমাগম ছিলো ইচলী ফেরিঘাট, সেই জায়গায় এখন নেমে এসেছে শুধুই নিরবতা।

খেয়া নৌকার সংখ্যা কমে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭/৮ টিতে। তাও দিনে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ এ নৌকা পারাপার করে থাকে।

ফেরিঘাটের নিয়মিত নৌকার মাঝি মনোহর বেপারী, শালু মাঝি, হজল বেপারী, খলিল গাজী, কাশিম গাজী, আব্দুল রাজ্জাক শেখ, মালেক বেপারী, লোকমান শেখ ও আলী আরশাদ গাজী বলেন, এক সময় দিনে অন্তত ৫–৬শ টাকা রোজগার হতো। এখন কোনোমতে এক দেড়শ টাকা হয়। মানুষই আর আসে না। নৌকা থেকে মানুষ উঠানামা করার জন্য ঘাটের তেমন কোন অস্তিত্বই নেই। এই প্রাণহীন নদীর ঘাটে যদি কোনরকম সিঁড়ি বা পাকাকরণ করা হতো। তাও অন্তত কিছু মানুষ এখান দিয়ে আসতো।

টোল আদায়কারী হারুন খান জানান, আগে প্রতিদিন টোল থেকে ৮–১০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠতো। এখন দৈনিক টোল আদায় হয় বড়জোর ২–৩শ টাকা।
দু’পারের টং দোকানগুলোরও অবস্থা করুণ। মানুষের অভাবে দিনের বেশিরভাগ সময় দোকানিরা খালি বসে থাকেন, বেচাকেনা নেই বললেই চলে।

এক সময় চাঁদপুর-ঢাকা লঞ্চগুলো ইচলী ঘাটে ভিড়ত। সেই ভিড়ে গড়ে উঠত দোকান, টোল, ব্যবসা আর মানুষের আনাগোনা। কিন্তু এখন দীর্ঘদিন ধরে কোনো লঞ্চই আর এখানে থামে না, ফলে ঘাটটি তার ঐতিহ্য ও কোলাহল হারিয়ে বিলিন হয়ে পড়েছে।

এখন কেবল বাগাদী, চৌরাস্তা, ইচলী, ঢালীর ঘাট ও আশপাশের গ্রামের কিছু মানুষ এ ঘাট ব্যবহার করেন, তাও খুবই সীমিত আকারে।

ইচলী ফেরিঘাটটি পুনরায় চালু হলে কিংবা সেখানে একটি ব্রিজ নির্মাণ হলে চাঁদপুরের ইচলী, ঢালীরঘাট, বালিয়া, বাগীদী, বাগড়া বাজার সহ দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের হাজারো মানুষের যাতায়াত অনেকটা সহজ হয়ে যেত। বিশেষ করে রোগী, শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী মানুষের শহরে যাতায়াতের ভোগান্তি কমত। এ ছাড়া শহরের প্রধান সড়কের যানজটও অনেকটা হ্রাস পেত। চিকিৎসা, শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ যেমন প্রসারিত হতো, তেমনি এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা হতো আরও গতিময় ও স্বাচ্ছন্দ্যময়। স্থানীয়দের মতে, দীর্ঘদিনের এই দাবি বাস্তবায়ন হলে পুরো এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসত এক ভিন্ন পরিবর্তন।

স্থানীয়রা বলেন,এই ঘাট শুধু এক টুকরো জমি নয়, এটি চাঁদপুরের ইতিহাসের অংশ, মানুষের স্মৃতি আর জীবনের সাথে জড়িত এক গল্প। যদি অন্তত ইচলী লঞ্চঘাটটি আবারো চালু করা যেত, এখানে মানুষ আসত, দোকানগুলো বাঁচত, মাঝিদের সংসারে হাসি ফিরত।

ইতিহাস আর নদীর ঢেউয়ে ভেসে চলা চাঁদপুরের ইচলী ফেরিঘাট এক সময় মানুষের স্বপ্ন আর জীবনের অংশ ছিল। ২০২৫ সালে এসে সেই ঘাট যেন নীরব স্মৃতির খাতায় রয়ে গেছে।

স্থানীয়দের দাবি একসময়ের এই আলোচিত ফেরিঘাটটি পুণরায় জাগ্রত করতে অন্তত পক্ষে ইচলী লঞ্চঘাট সক্রিয় করা হোক। যেনো আবার সেখানে ফিরে মানুষের হাঁকডাক আর লঞ্চের হুইসেল। তাহলে আবার নতুন রূপে তার যৌবন ফিরে পাবে অন্তত শতবছরের ঐতিহ্যের চাঁদপুর ইচলী ফেরীঘাট।

প্রতিবেদক: কবির হোসেন মিজি, ২৭ জুলাই ২০২৫