ভদ্রলোক একজন সফল শিল্পপতি। ব্যবসা-বাণিজ্য বলেন আর সামাজিক কর্মকাণ্ডই—কোথাও অসফল নন তিনি। অনেক বছর হলো সংসার করছেন। মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা হলো স্ত্রী নিয়ে। ‘এত বুদ্ধি কম তাঁর।’ বউকে নিয়ে হাসাহাসিও করলেন আমাদের সামনে।
আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না—স্ত্রীকে কম বুদ্ধির মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে পেরে তাঁর তৃপ্তির সীমা নেই। ‘বুঝতেই তো পারছেন, মেয়ে মানুষের এমনিতেই বুদ্ধি কম। আর আমার বউ তো আস্ত একটা গাধা। হা হা হা।’
লোকটা স্ত্রীর সামনেই বলছিলেন। স্ত্রী চুপচাপ তা শুনছিলেন। স্বামীর হাসিতে তিনিও মিটিমিটি হাসছেন। আলাদাভাবে কথা বললাম ‘কম বুদ্ধি’র সেই নারীর সঙ্গে। ঘটনা ঠিক উল্টো। তাঁর স্বামীর ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক অবস্থান—সব হয়েছে বউয়ের বাপের টাকায়। শ্বশুরই জামাইকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সে জন্য তাঁর স্বামী বেচারাই উল্টো হীনম্মন্যতায় ভুগছেন। ব্যবসায়িক পরিবারের মেয়ে তিনি। ফলে ব্যবসার অনেক কাজে বুদ্ধি দেন। স্বামী তাঁর এসব অবদানকে মনে রাখেন না। তাঁকে কম বুদ্ধির মানুষ বলে একধরনের আনন্দ পান। বুঝেও চুপচাপ থাকেন।
নারীদের বুদ্ধি কম; মেয়েরা পুরুষের তুলনায় কম যোগ্য; তাঁদের শারীরিক শক্তি কম। হাজার হাজার বছর ধরে জগদ্দল এক ধারণা পোষণ করে পুরুষ যে তৃপ্তি পায়, তার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই।
মেয়েদের বুদ্ধি কম, এমন অপধারণা পোষণ করেন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেন—এমন দৃষ্টান্তও পেয়েছি। অথচ তাঁর স্ত্রী এক হাতে তাঁর সংসার আপন ছন্দে পরিচালনা করেন। সংসারের কোনো সমস্যা, অভিযোগ, স্বামীর কানে যাওয়ার আগেই চমৎকার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মিটিয়ে ফেলেন। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ঢাকায় নিজেদের বাড়ি করতে মূল ভূমিকা রেখেছেন। নির্মাণকাজ তিনিই দেখভাল করেছেন। তারপরও স্বামীর চোখে বুদ্ধিমান হতে পারেননি। বরং স্বামীর তির্যক বাক্যবান সহ্য করে চলেছেন। জানতে চেয়েছিলাম, কেন এটা সহ্য করছেন? বললেন, ‘স্বামী বেচারা পড়াশোনার জগতের মানুষ। বইপত্র লেখা, অনুবাদ, গবেষণা নিয়ে থাকেন। একটু “আউলা টাইপ” লোক। পুরুষেরা অমনই হয়। মেয়েদের বোকা ভেবে তাঁরা মজা পায়।’
নারী কিংবা পুরুষ—কম বুদ্ধিসম্পন্ন যে কেউই হতে পারেন। একজন মানুষ সহজ-সরল, বোকাসোকা ধরনের হতে পারেন। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেই মানুষ যে নারীই হবেন, সেটা ঠিক নয়। মনোবিজ্ঞানী আদ্রিয়ান ফার্নহ্যাম তাঁর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলেছেন, বুদ্ধিমত্তার প্রশ্নে নারী-পুরুষের বিভাজন নিতান্তই মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। তিনি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন—বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজ্ঞতা, চর্চা, অনুশীলনের যেখানে সমসুযোগ রয়েছে। নারী কোনো অবস্থাতেই পিছিয়ে নেই। বরং নারী যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে তার যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন।
অনেক সময় মেয়েদের কম বুদ্ধির ভাবতে ও প্রচার করতে অনেক নারীও খুব আনন্দ পান। এমন ভাবনার কারণ কী! কারও মতে, মেয়েরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এখন একটু চাকরিবাকরি করছেন বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করলে তাঁদের চলবে না। শত শত বছর ধরে পুরুষ ঘরে ও বাইরে সামলাচ্ছেন। আয়-উপার্জন সবই তাঁদের হাতে। পুরুষের বুদ্ধি বেশি হবে না তো কার হবে! এমন ভাবনার নারীদের মতে, মেয়েদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম হওয়াই ভালো। তাতে ঘরসংসার করতে অনেক সুবিধা। বুদ্ধিমান নারীকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন একদম পছন্দ করে না।
পুরুষ কেন নারীকে কম বুদ্ধির ভাবতে ভালোবাসেন
প্রথম কারণ, হাজার বছরের প্রচলিত ধারণা ও কুসংস্কার। এর ফলে নারীকে নির্বোধ ও অযোগ্য প্রমাণ করে সাংসারিক-সামাজিকÿক্ষেত্রে অবমাননা করা, নারীকে দমিয়ে রাখা, নারীকে যোগ্য সম্মান না দেওয়া এবং তাঁর প্রতিষ্ঠায় বাধা দিতে চান অনেক পুরুষ।
সময় এখন বদলেছে। প্রতিদিনই বদলাচ্ছে। পুরোনো চিন্তাচেতনা নিয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা যাবে না। ধ্যানধারণা পাল্টে যুগোপযোগী করা দরকার।
স্বামী-আত্মীয়স্বজনদের কাছে নারীর বোকা সেজে থাকা কোনো কাজের কথা নয়। বুদ্ধির চর্চা কারও একচেটিয়া অধিকার নয়। সামাজিক, সাংসারিক ও কর্মজগতে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মুখে নিজেকে প্রস্তুত রাখা, সমস্যাকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলার মাধ্যমেই পুরুষের মতো একজন নারীরও বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতার বিকাশ ঘটে। সেটা সবার মনে রাখতে হবে। পুরুষের চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক ধারণাকে স্বীকৃতি দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। বরং যা সত্য, সেটাকে যুক্তি ও যোগ্যতার নিরিখে প্রতিষ্ঠা করাই শ্রেয়। অপধারণা, অপবাদ, অপযুক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া কখনোই ঠিক নয়। অধ্যাপক আদ্রিয়ান ফার্নহ্যাম তাঁর গবেষণায় বরং নারীকেই মর্যাদা দিয়েছেন। জানিয়েছেন, মাইন্ডরিডিং, সচেতনতা, সতর্কতা ইত্যাদির বিচারে বুদ্ধিমত্তায় নারীই এগিয়ে। নারী তাঁর কাজে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মানবিকতা, মনোযোগ, আন্তরিকতাকে যুক্ত করেন। নারী এ ক্ষেত্রে অনন্য।
চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক: ।। আপডেট ১২:০৭ পিএম ০৩ নভেম্বব, ২০১৫ মঙ্গলবার
ডিএইচ