দলিলপত্রে কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী থেকে নেওয়াশী ইউনিয়নে যাওয়ার রাস্তার পাশে ‘চামটা’ নদী; এখন ফসলের ও মাছের চাষ হয় নদীর বুকে। বিলুপ্তপ্রায় নদীটির চিহ্ন বহন করছে একটি নালা। তবে সরকারি কোনো সংস্থার খাতাপত্রে এর নাম নেই। খাগড়াছড়ির ‘ঠেগা’ নদীর নামও কোনো সরকারি সংস্থার তালিকায় নেই। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন,পানি উন্নয়ন বোর্ড,জেলা প্রশাসন বা বিভাগীয় কমিশনারদের তালিকায় নদী দুটির নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
বাদপড়া এসব নদীর নাম অন্তর্ভুক্ত করে নতুন তালিকা হয়নি; উল্টো কলমের খোঁচায় মুছে যাচ্ছে অনেক নদীর নাম। একটি বা দুটি বা পাঁচটি নয়, অন্তত ২৭৪টি নদীর নাম বাদ দিয়ে নতুন তালিকা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে,অবৈধ দখল পাকাপোক্ত করতেই যাচাই-বাছাই ছাড়াই নদীর নাম চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে সরকার। এসব নদীর নাম বাদ দিয়ে তালিকা চূড়ান্ত করলে দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যাচাই ছাড়া কোনো নদীর নাম বাদ না দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একটি নদীর নাম বাদ দিতে হলেও গণশুনানি আবশ্যক বলে মনে করেন তারা।
জানা গেছে,দেশের নদনদীর সঠিক সংখ্যা নিরূপণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) একটি প্রকল্প নিয়েছে। ‘বাংলাদেশের নদনদীসমূহের তথ্যাদি হালনাগাদকরণ ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে নদীর তালিকা করা হচ্ছে। দেশের আট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে তালিকা করা হয়েছে। তালিকা কমিশনারদের দাপ্তরিক ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এসব তালিকা অনুযায়ী দেশে মোট নদী ৬৮৫টি।
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম.ইনামুল হকের ‘বাংলাদেশের নদনদী’ বইয়ের (জনান্তিক/২০২০) তথ্যমতে, দেশে নদী ১ হাজার ১৮০টি। গত বছর নদীরক্ষা কমিশনের প্রকাশ করা বাংলাদেশের নদনদীর খসড়া তালিকায় নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮। তাদের হিসাবে অন্তত ৩২৩টি নদী তালিকা থেকে বাদ পড়ছে। তালিকাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কিছু নদী ভিন্ন নামে এবং ভিন্ন জেলায় রয়েছে। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, তারপরও অন্তত ২৭৪টি নদীর নাম পাওয়া যায়নি।
তালিকা থেকে বাদপড়া নদীগুলোর বেশিরভাগই প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে। তাদের নদীর জায়গা স্থায়ীভাবে ‘উপহার’ দেওয়ার জন্যই এ আয়োজন করা হচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। শুধু অফিসে বসে নয়, সরেজমিন গবেষণার মাধ্যমে নদীর তালিকা তৈরির তাগিদ দিয়েছেন তারা।
কুড়িগ্রাম জেলার চামটা নদীর বিষয়ে নাগেশ্বরী পৌরভূমি অফিস ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে জানা গেছে, নদীর জায়গায় প্রভাবশালীরা ধান ও মাছ চাষ করছেন। সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় ভূমি অফিস ও জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল নদীর জায়গা পরিদর্শনে যায়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়।
তাতে বলা হয়, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের তালিকায় এ নদীর নাম স্থানীয় প্রশাসন জমা দেয়নি। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী নদীর উৎস ও নির্গমন মুখ চিহ্নিত করে, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে দুই মাসের মধ্যে নদীর সীমানা নির্ধারণে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় তাদের তালিকায় ‘চামটা’ নদীর নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। নতুন তালিকায় বাদ পড়েছে নদীরক্ষা কমিশনের তালিকায় থাকা কুড়িগ্রাম জেলার ‘জলছেঁড়া’ ও ‘ধরনী’ নদীর নামও।
ঝালকাঠি জেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে চলা বাউকাঠি নদীর নামও নেই বিভাগীয় কমিশনারের তালিকায়। সরকারি তথ্য বাতায়নে নদীটিকে খাল উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও গত বছর বাউকাঠিকে নদী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনকে চিঠি দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন নদীটির তীরে অবৈধ দখল থাকলেও এখনো পানি বইছে। ছোট নৌকাও চলে। স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুল হক জানান, এ নদীতে এখনো পানি থই থই করে। দখল থাকলেও নদীটি এখনো অনেক মানুষের জীবিকার উৎস। ঈদসহ নানা উৎসবে এ নদীর তীরে মানুষজন ঘুরতে আসে।
রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ জেলায় প্রবহমান বারশিয়া নদী। জেলেরা মাছ ধরে। মানুষ নদীতে সাঁতার কাটে, গোসল করে। জমিতে সেচ দেন কৃষকরা। অথচ এটির নাম বাদ পড়েছে নতুন তালিকা থেকে। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের তালিকায় থাকলেও বিভাগীয় কমিশনারের এবারের তালিকায় ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ‘আলহরি’ নদীর নাম নেই।
নতুন তালিকা থেকে বাদপড়া নদীর মধ্যে রয়েছে নেত্রকোনার মাটিয়ারা, রংপুরের পলিমারি, খুলনার কিচিমিচি, কালিনগর, চুয়াডাঙ্গার ভাটুই, বাগেরহাটের ভেটকমারী, কুমিল্লার তুলসীঘাটা ও পাগলী, শরীয়তপুরের কুশা, মুন্সীগঞ্জের গোয়ালীমন্দ্রা,শরীয়তপুরের চরহোগলা, কিশোরগঞ্জের নাগশ্রী, টাঙ্গাইলের বলরাম, ফরিদপুরের বৈঠাখালী, মানিকগঞ্জের সুদখিরা, বরগুনার টেপুরা, লালমনিরহাটের মালদাহা ও সিমলাজান, সিরাজগঞ্জের কালুদাহা ও বানিয়াজান, জয়পুরহাটের নুনগোলা ছোট, সিলেটের ১৪৬-বিগাং, কুশি ও ইটাখলা, সুনামগঞ্জের ভাটিকারা ও খরচা নদী।
নাগরিকদের অভিযোগ, সরকারি লোকজন সচিবালয়ে বসে নদীর তালিকা ঠিক করছে। জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় ভূমি অফিস যে তালিকা করছে তাতে সঠিক চিত্র উঠে আসছে না। সরেজমিন পরিদর্শন ছাড়া তালিকা প্রকাশ করা জবরদখলকে বৈধতা দেয়ার শামিল।
বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে যোগাযোগ করে জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে নদনদীর তালিকা করেছে তারা। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে পাওয়া তালিকা একত্রিত করে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছি। এটাই পানি উন্নয়ন বোর্ডে পাঠানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো নদীর নাম বাদ পড়লে তা অবশ্যই যুক্ত হবে। তবে নদীর নামের ভিন্নতা রয়েছে। প্রায়ই দেখা যায়, কাগজপত্রে এক নাম আর মানুষের মুখে অন্য নাম। এটাও বাদ পড়ার একটি কারণ। সত্যিই বাদ পড়েছে কি না, যাচাই করে দেখা হবে।’
১০ অক্টোবর পানি সম্পদ ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সভাপতিত্বে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়। সভায় নদনদীর আঞ্চলিক বা পরিচিত নাম অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রবাহমান নদী, হারিয়ে যাওয়া বা শুকিয়ে যাওয়া নদীর নাম, নদীর উৎস মুখে এবং ভাটিতে স্থানীয় কী নাম তা উল্লেখ করা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, নদীরক্ষা কমিশন এবং জেলা ও বিভাগীয় তালিকা বিশ্লেষণ করে আদালতের রায় অনুযায়ী সিএস/আরএস রেকর্ডমতে,নদনদীর তালিকা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের তালিকাকেই চূড়ান্ত করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পসংশ্লিøষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা তড়িঘড়ি করে এ তালিকা প্রকাশ করতে চান।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বলেন, ‘এখনো নদীর তালিকা চূড়ান্ত হয়নি। বিভাগীয় কমিশনাররা তালিকা পাঠিয়েছেন। এসব নিয়ে আমরা জাতীয় পর্যায়ে একটি কর্মশালা করব। কোনো নদী বাদ গেলে আপত্তি তোলার সুযোগ আছে। নদীর তালিকা চূড়ান্ত করার আগে আবার মন্ত্রণালয়,নদীরক্ষা কমিশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেয়া হবে। বাদপড়া নদীর নাম তালিকায় যুক্ত করার সুযোগ থাকবে।’
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো.আবুল ইসলাম বলেন,‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। পরবর্তী মিটিংয়ের পর বিষয়টি বোঝা যাবে।’
কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন ড.মন্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন,‘আমরা নদীর জমির রেকর্ড এবং প্রবাহ দেখে তালিকা প্রস্তুত করেছি। শুধু পানিপ্রবাহ দেখে নদীর সংখ্যা নির্ধারণ করলে হবে না। অনেক জায়গায় পানি নেই,কিন্তু রেকর্ডে নদী আছে সেটিকেও ধরতে হবে। এসব বিষয় মাথায় নিয়ে জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা ভূমি অফিসের সঙ্গে সমন্বয় করেই তথ্য দিয়েছিলেন।’
তিনি বলেন,‘আমার সময়ের তালিকা থেকে কিছু নদীর নাম বাদ পড়ে থাকতে পারে। নতুন তালিকায় সেসব যুক্ত করতে হবে। বাদপড়া নদীর সংখ্যা কিছুতেই ২০০ বা ৩০০ হতে পারে না।’
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম ইনামুল হক বলেন, ‘দেশে দু থেকে তিন হাজার নদী আছে। আমার বইতে ১ হাজার ১৮০টি নদীর কথা উল্লেখ করেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড চাইলে আমার পরামর্শ নিতে পারত। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন চাইলে সব নদীর তথ্য জোগাড় করতে পারে। এজন্য সদিচ্ছার প্রয়োজন।’নিউজ সূত্র: দেশ রূপান্তর
চাঁদপুর টাইমস রিপোর্ট
৩০ নভেম্বর ২০২৪
এজি