বাংলাদেশে বর্তমানে তিন ধরনের সংবাদ মাধ্যম রয়েছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন রেডিও এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্মার্টফোনের কারণে অবশ্য এর বাইরে সিটিজেন জার্নালিজমের এক বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে; যেখানে একজন ব্যক্তি নিজে রিপোর্টার নিজেই সম্পাদক নিজেই প্রকাশক। লেখাটি প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে করণীয় নিয়ে ।
প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যম ইতিহাসের সর্বোচ্চ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গণমাধ্যমের উপর গণমানুষের আস্থা তলানিতে এসে ঠেকেছে। গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার পক্ষে বেশিরভাগ গণমাধ্যম দাঁড়ায়নি। ফলস্বরপ ক্ষুব্ধ জনতা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বেশ কয়েকটি টেলিভিশন ও পত্রিকা অফিসে ভাংচুর চালিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে বাঙ্গালির স্বাধিকারের পক্ষে ইত্তেফাকের অবস্থানের কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ইত্তেফাক অফিস পুড়িয়ে দিয়েছিল। তখন সাধারণ মানুষ ইত্তেফাককে সুরক্ষার চেষ্টা চালিয়েছে। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন চলাকালীন বেশিরভাগ গণমাধ্যমের ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারের পক্ষে নির্লজ্জ অবস্থান নেয়। গণঅভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরে কিছু মিডিয়া হাউসে ভাংচুরের পরও গণমাধ্যমের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি তৈরি হয়নি। কারণ ১৫ বছরে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের একটি অংশের নির্লজ্জ দালালি ও তোষামোদি সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে জীবন্ত আছে বলে। যে কোনো গণমাধ্যমে হামলা নিন্দনীয়। কিন্তু গত সময়ে আমাদের গণমাধ্যম কতটা গণমানুষের ছিল?
গণমাধ্যমের ক্ষমতার উৎস
গণমানুষ গণতন্ত্র গণমাধ্যম তিনটি শব্দে ‘গণ’ শব্দটি সাধারণ। গণমাধ্যম থেকে যদি ‘গণ’ উধাও হয়ে যায় তবে সেটি শুধুই একটি প্রচারমাধ্যমে পরিণত হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান একটি পেশাকে গণমানুষের পক্ষে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার জন্য অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। সাধারণ মানুষ ক্ষমতাহীন মানুষ প্রান্তিক মানুষের পক্ষে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ক্ষমতাহীনের পক্ষে এই স্বাধীনতার চর্চা যারা করেন তাদেরকে বলা হয় সাংবাদিক। ক্ষমতা যাতে সীমা ছাড়িয়ে স্বৈরাচার হতে না পারে সেজন্য সাংবাদিকরা ক্ষমতাকে চোখে চোখে রাখেন। তার ক্ষমতার উৎসও তাই গণমানুষ। তার আইনি ভিত্তি দিয়েছে সংবিধান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে হিটলার ও নাজিদের উত্থানের পেছনে সাংবাদিক ও তথাকথিত গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল। পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার যেভাবে নানা ধরনের শব্দবন্ধ দিয়ে চেতনার ব্যবসায় গণমাধ্যমকে দোসর করেছিল ঠিক তেমনিভাবে হিটলার ও নাজি এবং ইতালিতে মুসোলিনি একই ধরণের কৌশল ব্যবহার করেছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কি আদৌ ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে রাখার প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি রাখে কিনা। নাকি আমরা না জেনে তাদের কাছ থেকে গণমানুষের পক্ষে তাদের অবস্থানের অন্যায্য দাবি করছি।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সীমা
আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যাপক স্বাধীনতা ভোগ করে বলে মনে হয়। কিন্তু তার স্বাধীনতা নানা স্থানে বর্গা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে বিগত সরকারের অবাধ গণমাধ্যমের লাইসেন্স প্রদান। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিযোগীতার মধ্যে ঠেলে দিয়ে একটি বিশৃঙ্খলতার মাধ্যমে সেন্সরশিপ চর্চা করা এবং তার পক্ষে ‘নির্লজ্জ দালালি’র ক্ষেত্র প্রস্তুত রাখাই ছিল তার উদ্দেশ্য। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা সংস্থার যথেচ্ছা ব্যবহার নগ্নতার সীমাকে ছাড়িয়েছে।
পরিবর্তন আনা যায় যেভাবে
গণঅভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশের টেলিভিশন মিডিয়াগুলোর চেয়ে সংবাদপত্রগুলো বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। যদিও কিছু সম্পাদকের গণহত্যার পক্ষে অবস্থান সাংবাদিক সমাজকে লজ্জায় ডুবিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনের সময় স্বৈরতন্ত্রের সহযোগী হিসেবে টেলিভিশন মিডিয়ার নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হচ্ছে। এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, টেলিভিশনগুলো যখন সঠিক সংবাদ দিচ্ছিল না তখন অনেকদূর পথ পাড়ি দিয়ে সঠিক সংবাদ পাওয়ার জন্য তিনি পত্রিকা সংগ্রহ করতেন।
মাত্র দুটি টেলিভিশন কিছুটা সাহস দেখিয়েছে। অন্য টেলিভিশন গুলোর নতজানু ও তোষণের ব্যাপ্তির এতটাই ছিল যে দুই টেলিভিশনের নুন্যতম বস্তুনিষ্ঠতার চর্চা আমাদের কাছে অনেক বেশি মনে হয়েছে। কিন্তু কেন? বাকি টেলিভিশনগুলো কি আসলেই সঠিক সংবাদ দিতে চায় না বা আমরা কি শুধুই গণমাধ্যমের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর গণমাধ্যমের জনস্বার্থে কাজ করার এখতিয়ার ছেড়ে দিতে পারি?
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা
বাংলাদেশে টেলিভিশনগুলোর ক্ষমতা তোষণের বিপদজনক চর্চা পরিলক্ষিত হয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের সংবাদ পরিবেশন এর সময়। দর্শক যখন প্রতি মুহূর্তে সঠিক তথ্যটির জন্য দেশের ৩০টি টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে ছিল তখন বেশিরভাগ টেলিভিশন সরকার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কখনো অর্ধ-সত্য কখনো অসত্য সংবাদ পরিবেশন করে গেছে। এই সময় মানুষ তথ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভর হয়ে পড়েছিল। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হলে একমাত্র ভরসা হয়ে পড়ে সংবাদপত্র।
টেলিভিশনে যেকোনো জনস্বার্থ বিরোধী প্রতিবেদনের জন্য যে কোন নাগরিক বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ওই টেলিভিশনের মালিক সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। কমিশন চাইলে স্বত:প্রণোদিত হয়ে একই ধরনের প্রতিবেদনের জন্য জবাবদিহী চাইতে পারবেন। টকশোতেও যেকোনো জনস্বার্থে বিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্যের জন্য টকশো পরিচালনাকারীকে বিচারের আওতায় আনা যাবে
বাংলাদেশে একটা টেলিভিশনের সম্প্রচার যত সহজে বন্ধ করা যায় যত সহজে তাকে প্রচারমাধ্যমে পরিণত করা যায় সংবাদপত্রকে তত সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ বিগত স্বৈরাচার সরকার আরও বেশি পোক্ত করেছিল। এখন গণমাধ্যম কমিশন করে কিভাবে গণবিরোধী বা ক্ষমতা তোষণের মিডিয়াকে জনস্বার্থে ব্যবহার করা যায় সেই মেকানিজম করতে হবে।
কেমন হবে গণমাধ্যম কমিশন
১. সংবাদপত্রের জন্য বর্তমানে প্রেস কাউন্সিল রয়েছে। কিন্তু তার আর্থিক স্বাধীনতা না থাকায় সে তার ক্ষমতার পূর্ণচর্চা করতে পারে না। প্রেস কাউন্সিল ব্যবহারে জনগণেরও সোচ্চার হতে হয়। প্রতিষ্ঠান থাকলেও জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারে জনগণকে তার ক্ষমতার চর্চা করতে হয়। আমরা গণমাধ্যম নিয়ে যত সমালোচনা করি গণমাধ্যমকে জনস্বার্থে ব্যবহারে তত কাজ করিনা। নতুন গণমাধ্যম কমিশনের অধীন প্রেস কাউন্সিলে জনস্বার্থবিরোধী যে কোন সংবাদ প্রকাশের জন্য যেকোনো নাগরিক প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ দিতে পারবে। তিন থেকে সাত কার্য দিবসের মধ্যে দ্রুত সময়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে হবে। জনস্বার্থ বিরোধিতার স্তর অনুযায়ী আর্থিক জরিমানা ও শাস্তির বিধান থাকবে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের জন্য অভিযোগকারীকেও জরিমানার বিধান রাখা যাবে।
২. টেলিভিশনের জন্য আলাদা সম্প্রচার কমিশন গঠন করতে হবে। একজন বিচারপতি বা স্বনামধন্য সাংবাদিকের নেতৃত্বে কমিশন হতে পারে। কমিশনে একজন তরুণ সাংবাদিক, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাবের একজন প্রতিনিধি থাকবেন। যখন যে বিষয়ে জনস্বার্থ বিরোধী প্রতিবেদনের অভিযোগ আসবে সংশ্লিষ্ট সে বিষয়ে যারা জনস্বার্থে কাজ করেন তাদেরকে কমিশন বিচারিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। সম্প্রচার কমিশন আর্থিকভাবে স্বাধীন হবেন এবং তার জন্য সরাসরি বাজেট বরাদ্দ থাকবে।
টেলিভিশনে যেকোনো জনস্বার্থ বিরোধী প্রতিবেদনের জন্য যে কোন নাগরিক বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ওই টেলিভিশনের মালিক সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। কমিশন চাইলে স্বত:প্রণোদিত হয়ে একই ধরনের প্রতিবেদনের জন্য জবাবদিহী চাইতে পারবেন। টকশোতেও যেকোনো জনস্বার্থে বিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্যের জন্য টকশো পরিচালনাকারীকে বিচারের আওতায় আনা যাবে। তবে শোতে অংশ নেয়া অতিথিদের বক্তব্যের জন্য তারা নিজেরা দায়ী থাকবেন। যেকোন অভিযোগ ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বাধ্য থাকবে কমিশন।
৩. কোনো গণমাধ্যমকে গোয়েন্দা সংস্থা কোনো ধরনের নির্দেশনা দিতে পারবে না।
৪. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা কোন গণমাধ্যম পরিচালিত হবে না। সরকারের নির্দেশনায় বা গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা কোন সংবাদপত্র অনলাইন বা টেলিভিশন পরিচালনা করতে পারবেনা। বর্তমানে যেগুলো রয়েছে সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।
৫. জনস্বার্থ বিরোধী প্রতিবেদন তৈরিতে কোন গণমাধ্যম কর্মীকে তার প্রতিষ্ঠান বাধ্য করতে চাইলে অভিযোগ সাপেক্ষে তাকে প্রয়োজনীয় আইনি সুরক্ষা দেবে গণমাধ্যম কমিশন।
৫. সংবাদপত্রের জন্য ওয়েজ বোর্ড রয়েছে। টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের জন্য আলাদা ওয়েজ বোর্ড ঘোষণা করবে।
৬. গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের রিপোর্ট প্রতি তিন মাস অন্তর কমিশনের কাছে জমা দিবে।
৭. জনস্বার্থ বিরোধী যেকোনো কর্মসূচি বা অবস্থানের জন্য সাংবাদিক সংগঠনকে কমিশন চাইলে জবাবদিহীর আওতায় আনতে পারবে। এ ধরনের কার্যকলাপের জন্য যে কোন ব্যক্তি অভিযোগ ও বিচার চাইতে পারবে।
৮. সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার নুন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক হতে হবে। একজন সাংবাদিকের বেতন কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা হতে হবে। প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট দিতে বাধ্য থাকবে প্রতিষ্ঠান।
৯.টেলিভিশন ও সংবাদপত্র মনিটরিং এর জন্য গোয়েন্দা সংস্থার কাছে থাকা প্রযুক্তি গণমাধ্যম কমিশনের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
১০ কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে। কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পক্ষ চাইলে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবে।
১১. কোন গণমাধ্যম মালিক তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষা দিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন করতে পারবে না। নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সংবাদ পরিবেশন ‘স্বার্থের সংঘাত’ রূপে বিবেচিত হবে।
মাশরুর শাকিল,সিনিয়র সাংবাদিক,চ্যানেল আই
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
এজি