Home / বিশেষ সংবাদ / মেজর আরিফসহ র‌্যাব পুরো মিশনে ছিলো ছদ্মবেশে
মেজর আরিফসহ র‌্যাব পুরো মিশনে ছিলো ছদ্মবেশে

মেজর আরিফসহ র‌্যাব পুরো মিশনে ছিলো ছদ্মবেশে

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে অনুসরণ, অপহরণ ও হত্যার পর লাশ গুম করা পর্যন্ত ছদ্মবেশ ধারণ করেন কমান্ডার মেজর আরিফসহ র‌্যাব-১১-র সদস্যরা। এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে মেজর আরিফসহ অন্য র‌্যাব সদস্যদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে।

ওই মামলায় র‌্যাব-১১-র অধিনায়কসহ বাহিনীর ১৭ জন এবং নূর হোসেনের কয়েকজন সহযোগী আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

তারা স্বীকার না করলেও আইনজীবীরা মনে করেন, হত্যার পূর্বপরিকল্পনা ছিল বলেই এ ছদ্মবেশ ধারণ। এমনকি নজরুলসহ সাতজনকে আটক করে যে দুটি গাড়িতে তোলা হয় সেগুলোও ছিল নম্বর প্লেটবিহীন।

ঢাকা আদালতের সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী বলেন, প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী ধরতে ছদ্মবেশ ধারণের প্রয়োজন পড়ে না। নারায়ণগঞ্জের সাতজনকে আটক, খুন ও লাশ গুমের চেষ্টাই প্রমাণ করে র‌্যাব গোপনে কাজটি করতে চেয়েছিল।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আমিনুল গণি টিটো বলেন, যেকোনো সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করতে পারে র‌্যাব। এ জন্য নানা কৌশল থাকতে পারে। ছদ্মবেশ ধারণও র‌্যাবের কৌশল হতে পারে। তবে প্রকাশ্যে কাউকে আটকের ক্ষেত্রে ছদ্মবেশের প্রয়োজন নেই। আবার গ্রেপ্তারের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানানো ও সাতজনকে খুন করে নদীতে লাশ ফেলে দেওয়ার ঘটনায় প্রতীয়মান হয়, র‌্যাব সদস্যরা অসৎ উদ্দেশ্যে ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে নজরুল ইসলাম, চন্দন সরকারসহ সাতজনকে লিংক রোড থেকে আটক করা হয়। এরপর তাঁদের চোখ বেঁধে র‌্যাব-১১-র নরসিংদী ক্যাম্পের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ক্যাম্প থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে মেজর আরিফের নেতৃত্বাধীন গাড়িবহর থামে। সেখান থেকে নরসিংদী ক্যাম্পের কম্পানি কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ সুরুজ মিয়াকে ফোন করেন মেজর আরিফ। মেজর সুরুজের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে নকল দাড়ি-গোঁফ লাগান মেজর আরিফ। এরপর তিনি গাড়ি থেকে নেমে সুরুজের সঙ্গে কথা বলেন। তবে মেজর সুরুজের আপত্তিতে আটক সাতজনকে নিয়ে নরসিংদী ক্যাম্পে ঢুকতে পারেননি মেজর আরিফ ও তাঁর দলের সদস্যরা।

এ বিষয়ে ওই গাড়িতে থাকা র‌্যাব সদস্য সিপাহি আবু তৈয়ব আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, ‘নরসিংদী র‌্যাব ক্যাম্পের সামনে একটি ফাঁকা জায়গায় মাইক্রোবাস দুটি থামে। মেজর আরিফ স্যার নকল দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে গাড়ি থেকে নামেন এবং মেজর সুরুজ স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।’

আসামি ল্যান্স নায়েক মো. হীরা মিয়া তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘নরসিংদী র‌্যাব ক্যাম্পের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে মেজর আরিফ স্যার নকল দাড়ি-গোঁফ লাগান।’

নজরুল ইসলামকে আটকের জন্য আদালতে র‌্যাব সদস্যদের সোর্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সিপাহি তৈয়ব ও হাবিলদার এমদাদ নারায়ণগঞ্জ আদালতে যান। সিপাহি তৈয়ব পাজামা-পাঞ্জাবি ও পাগড়ি পরে নজরুলকে অনুসরণ করেন।

ল্যান্স নায়েক মো. হীরা মিয়া জবানবন্দিতে বলেন, ‘মেজর আরিফ স্যার সিপাহি তৈয়ব ও হাবিলদার এমদাদকে আদালতের মধ্যে পাঠান। ওই সময় তৈয়বের পরনে খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি ও পাগড়ি ছিল।’

তৈয়ব জবানবন্দিতে বলেন, ‘নজরুলকে গ্রেপ্তারের আগে সকাল সাড়ে ৯টায় সৈনিক মিলন আমাকে বলে, তাড়াতাড়ি রেডি হও। মেজর আরিফ স্যারের সঙ্গে জরুরি অপারেশন আছে। আমি সাদা পোশাক এবং অস্ত্র ইস্যু করে আরিফ স্যারের অফিসের সামনে আসি। স্যার আমাকে বলেন, তুমি পাঞ্জাবি ও পাগড়ি পরে আসো। আমার মুখে ফোড়া হওয়ার কারণে কয়েক দিন শেভ করতে পারিনি। আমার মুখে দাড়ি দেখে আরিফ স্যার এই পোশাক পরতে বলেন। আমি বলি, আমার পাঞ্জাবি আছে, পাজামা নেই। তখন আরিফ স্যার আমাকে একটি প্যাকেট দিয়ে বলেন, এর মধ্যে সব আছে পরে নাও।’

তৈয়ব স্বীকারোক্তিতে আরো বলেন, ‘আদালতের মধ্যে পরিচয় গোপন করে নজরুল ইসলামকে অনুসরণ করায় স্থানীয় লোকজন আমাদের (আমি ও হাবিলদার এমদাদ) ধরে পুলিশে দেয়। পরে র‌্যাব পরিচয় দেওয়ার পর পুলিশ ছেড়ে দেয়। আমরা আরিফ স্যারকে ঘটনা জানাই। তিনি চলে আসতে বললে আমরা র‌্যাবের গাড়িতে চলে যাই। এরপর অন্য একজন সিপাহি সাদা পোশাকে আদালতে যায়।’

মেজর আরিফ তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘কোর্টে নজরদারি করার সময় নজরুলের লোকজন সিপাহি তৈয়বকে আটক করেছিল। পরে তৈয়ব পরিচয় দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল।’ তিনি আরো বলেন, ‘নজরুলসহ সাতজনকে আটক করার পর মাইক্রোবাসে তুলে তাঁদের নিয়ে নরসিংদী ক্যাম্পের দিকে যাই। ক্যাম্পের বাইরে মেজর সুরুজ স্যারের সঙ্গে দেখা করি। তাঁর কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে খাবার কিনে খাই।’

কম্পানি কমান্ডার (সিও) লে. কর্নেল তারেক সাঈদও তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, নজরুলসহ অন্যদের আটকের পর মেজর আরিফ তাঁকে ফোন করে বলেন, ‘স্যার টার্গেট পিকডআপ। সঙ্গে চারজন আছে। আমি সবাইকে নিয়ে নরসিংদী র‌্যাব ক্যাম্পে যাচ্ছি।’

তারেক সাঈদ আরো বলেন, ‘মেজর আরিফকে জিজ্ঞাসা করি সাতজনকে কে মেরেছে? তখন মেজর আরিফ বলেন, নজরুল আমাকে (আরিফ) চিনে ফেলেছে। অন্যরাও দেখে ফেলেছে। এই কারণে ভয়ে তাদেরও মেরে ফেলেছি।’

মেজর তারেক সাঈদের এই স্বীকারোক্তিই প্রমাণ করে মেজর আরিফ তাঁর পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করেছেন।

র‌্যাব দুই রঙের দুটি নম্বরবিহীন গাড়ি ব্যবহার করে : আসামিদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, নজরুলকে আটক করতে র‌্যাব দুটি গাড়ি ব্যবহার করে। একটি সিলভার রঙের, অন্যটি নীল। সিলভার রঙের মাইক্রোবাসে করপোরাল মোখলেছুর রহমানের নেতৃত্ব ছয়জন ও নীল মাইক্রোবাসে মেজর আরিফ, লে. কমান্ডার মাসুদ রানা, কনস্টেবল হাবিসহ কয়েকজন ছিলেন। দুটি গাড়িই ছিল নম্বর প্লেটবিহীন। র‌্যাব সদস্য আবুল কালাম আজাদ তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি অপারেশনে যেতে সিলভার কালারের একটি নম্বরবিহীন মাইক্রোতে উঠি। এর ড্রাইভার ছিল রুহুল আমিন। করপোরাল মোখলেছুর রহমান তাঁদের নেতৃত্ব দেন।’

এই মামলার আসামি র‌্যাবের গাড়িচালক মো. রুহুল আমিন জবানবন্দিতে বলেন, ‘২৭ এপ্রিল সকাল ৯টা সাড়ে ৯টায় আরিফ সাহেব জরুরি অপারেশনে যাওয়ার জন্য গাড়ি প্রস্তুত করতে বলেন। আমি র‌্যাব-১১-র যানবাহন শাখার দায়িত্বে ছিলাম। ড্রাইভারের সংকট থাকায় নিজেই নম্বরবিহীন সিলভার রঙের মাইক্রোবাস প্রস্তুত করে র‌্যাব ক্যাম্পের সামনে আসি। পরে অপারেশনে যাই।’

রুহুল আমিন আরো বলেন, ‘আমরা মেজর আরিফ সাহেবের কম্পানিতে যোগ দিয়ে তাঁর অপারেশনে সহযোগিতা করি। আমরা করপোরাল মোখলেছের নেতৃত্বে সোয়া ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ নতুন কোর্টের সামনের রাস্তায় এসে দেখি সেখানে একটি নম্বরবিহীন নীল রঙের হাইয়েস মাইক্রোবাস দাঁড়ানো। ওই গাড়িতে মেজর আরিফ স্যারসহ অন্যরা ছিলেন।’

সূত্র : কালেরকণ্ঠ

নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০৬:২৮ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫, সোমবার

এমআরআর