Home / বিশেষ সংবাদ / দেশে প্রতি বছরে আড়াই লাখ মানুষ কুকুরের কামড়ের চিকিৎসা নেন।
কুকুরের কামড়ের চিকিৎসা

দেশে প্রতি বছরে আড়াই লাখ মানুষ কুকুরের কামড়ের চিকিৎসা নেন।

দেশে ২০১০ সালের আগে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতেন। আর মানুষ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবাদি পশুও এই রোগে মারা যেতো, তবে তার সঠিক পরিসংখ্যান অজানা। ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে জলাতঙ্কমুক্ত করার লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলাতঙ্ক রোগীর সংখ্যা পূর্বে তুলনায় কমলেও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমেনি। সবচেয়ে বেশি জলাতঙ্ক রোগী পাওয়া যায় ঢাকায়। এমন পরিস্থিতিতেই পালিত হচ্ছে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য– ‘জলাতঙ্কের অবসান, সকলে মিলে সমাধান’।

চিকিৎসকরা জানান, জলাতঙ্ক রোগ শুধু কুকুর কামড়ালেই হয় না। বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বানরের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমেও এই রোগ হতে পারে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে পানিভীতি, আলোভীতি, বায়ুভীতি হলেও এর শেষ পরিণতি মৃত্যু। তবে এই রোগ শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। যদি কোনও প্রাণী, বিশেষ করে কুকুর, বিড়াল, বানর, বেজি বা শিয়াল কামড় বা আঁচড় দেয়, সঙ্গে সঙ্গে সাবান পানি দিয়ে আক্রান্ত স্থান ১৫ মিনিট ধুতে হবে। পরে সময়মতো জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা নিলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

টিকা প্রয়োগের কারণে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে জলাতঙ্কে মৃত্যু। একবার জলাতঙ্ক হয়ে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত। তবে প্রাণীর কামড়ের পরপর টিকা নিয়ে নিলে মৃত্যু ও জলাতঙ্ক রোধ করা যায়। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের। এর মধ্যে শুধু ঢাকার সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ৩০ জন জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের দেয়া তথ্য মতে, গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, শতকের ঘর থেকে জলাতঙ্ক রোগীর সংখ্যা নিচের দিকে নামছে। ২০১৪ সালে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়েছে ১০৬ জন, ২০১৫-তে ৮৩ জন, ২০১৬-তে ৬৬ জন, ২০১৭-তে ৮০ জন, ২০১৮ ও ২০১৯-এ ৫৭ জন, ২০২০ সালে ২৬ জন, ২০২১ সালে ৪০ জন, ২০২২ সালে ৪৫জন এবং এই বছরের জুন পর্যন্ত ২৭ জন আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরাও আছেন।

দেশে প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখ মানুষ কুকুরের কামড়ের চিকিৎসা নেন। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৪ সালে কুকুরের কামড় খেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে রোগীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬২১ জন। আর গত বছর এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৫১ হাজার ৮৯৮। এই বছরের জুন পর্যন্ত ২ লাখ ৫৬ হাজার ৮০১ জন কুকুরের কামড় খেয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন ২০২২ সালে।

রাজধানীর সংক্রামক ব্যধি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জলাতঙ্ক রোগীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। তাই কুকুর, বিড়াল কিংবা অন্যান্য প্রাণী কামড় কিংবা আঁচড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে যদি ১৫ মিনিট সেই জায়গা ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে ধোয়া হয় তাহলে কিন্তু সংক্রমণের শঙ্কা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কমে যায়। আর কামড় দিলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে নিকটস্থ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কিংবা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কামড়ের জন্য তার টিকা নেওয়ার প্রয়োজন আছে, আবার কামড়ের ফলে যদি রক্তপাত হয় তাহলে তাহলে টিকার সঙ্গে আরেকটি আরআইজি দিতে হবে।

তিনি আর বলেন, শতকরা ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে কুকুরের কামড়-আঁচড়ে জলাতঙ্ক সংক্রমিত হয়ে থাকে। যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের ডেথ রিভিউ করতে হবে। কোন কারণে মারা গেলো, কোন কারণে জলাতঙ্কে আক্রান্ত হলো; এই সমস্যাগুলো বের করতে পারলে আমরা আমাদের লক্ষ্য জলাতঙ্ক মুক্ত করা সেটি করা সম্ভব।

এদিকে জলাতঙ্ক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সভায় মুল প্রবন্ধে হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. জুবায়ের আহমেদ জানান, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জলাতঙ্কের জন্য ঝুঁকি প্রবণ এলাকা এবং এখানে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলো জলাতঙ্কের হার খুবই কম। কারণ সেখানে পোষা ও রাস্তার কুকুরগুলোকে নিয়মিত টিকা দেওয়া হয়।

ডা. জুবায়ের আহমেদ বলেন, জলাতঙ্ক রোগী সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে ঢাকায়। এরপর কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ জেলায়। এসব রোগীরা কুকুরের কামড়ের কারণে জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। অথচ কুকুরে কামড়ের পর ক্ষত জায়গায় ১৫ মিনিট ক্ষারীয় সাবান দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে ৯০ শতাংশ জীবানু মরে যায়। জলাতঙ্ক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের ম্যানেজার ডা. শ ম গোলাম কায়ছার বলেন, ‘জলাতঙ্ক একটি ভয়ংকর মরণব্যাধি, এ রোগে মৃত্যুর হার শতভাগ। পৃথিবীতে প্রতি বছরে প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ মানুষ কুকুর, বিড়াল ও শিয়ালের কামড় বা আঁচড়ের শিকার হয়ে থাকে। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু।’

তিনি বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে জলাতঙ্ক মুক্ত করার লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন চলছে।’

বর্তমানে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর নির্ভর করে পরিবেশে জলাতঙ্কের প্রধান উৎস কুকুরের মধ্যে ব্যাপকহারে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিন প্রদান করা হচ্ছে। ব্যাপকহারে কুকুরের টিকাদান (এমডিভি) কার্যক্রমের মাধ্যমে ইতিমধ্যে দেশের ৬৪টি জেলায় ১ম রাউন্ড, ৩৭টি জেলায় ২য় রাউন্ড এবং ৮টি জেলায় ৩য় রাউন্ড ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের মাধ্যমে কুকুরকে প্রায় ২৭ লাখ ৭০ হাজার ডোজ জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা প্রদান করা হয়েছে, যা মানুষ ও প্রাণিদেহে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
এজি