ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে চার-পাঁচ কোটি মানুষ থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত। সারা বিশ্বে প্রায় ৮০ কোটি মানুষ এ সমস্যার শিকার। কিন্তু থাইরয়েড বিষয়ে জনসচেতনতার নিদারুণ ঘাটতি রয়েছে। যদিও থাইরয়েডজনিত রোগের ব্যাপকতা ও গভীরতার বিবেচনায় এ বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা এখন সময়ের দাবি।
থাইরয়েড গ্রন্থি একটি অতি প্রয়োজনীয় অন্তঃক্ষরা (এন্ডোক্রাইন) গ্ল্যান্ড, যা গলার সামনের অংশে অবস্থিত। এটি মানব শরীরের প্রধান বিপাকীয় হরমোন তৈরিকারী গ্ল্যান্ড। থাইরয়েড থেকে নিঃসৃত প্রধান কার্যকরী হরমোনগুলো টিএসএইচ নামক আরেকটি হরমোন তৈরি করতে সাহায্য করে, যা মস্তিষ্কের ভেতর পিটুইটারি নামের গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হয়।
থাইরয়েড হরমোনের অন্যতম কাজ হচ্ছে শরীরের বিপাকীয় হার বা বেসাল মেটাবলিক রেট বাড়ানো। থাইরয়েড হরমোনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে স্নায়ুর পরিপক্বতা। এজন্য গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোনের স্বল্পতায় গর্ভের শিশু বোকা হয় অথবা বুদ্ধিদীপ্ত হয় না। কিছু কিছু উদ্দীপনায় বিপাক ক্রিয়া বেড়ে যায় যেমন যৌবনপ্রাপ্তি, গর্ভাবস্থা, শারীরবৃত্তীয় কোনো চাপ ইত্যাদি কারণে থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের আকারগত বা কার্যকারিতায় পরিবর্তন হতে পারে।
থাইরয়েড গ্রন্থির মূলত দু ধরনের সমস্যা দেখা যায়, গঠনগত ও কার্যগত। এরা বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ পেতে পারে।
গঠনগত সমস্যায় থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যায়, যেটাকে গয়টার বা গলগণ্ড বলা হয়। যার আবার রয়েছে নানা প্রকারভেদ। এছাড়া থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের গোটা বা নডিউল এবং থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের ক্যান্সার হতে পারে।
কার্যগত সমস্যা দু রকমের হয়ে থাকে, তা হলো থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতা বা হাইপারথাইরয়েডিজম ও থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের কার্যকারিতা হ্রাস বা হাইপোথাইরয়েডিজম। এছাড়া থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের প্রদাহ বা থাইরয়েডাইটিস হতে পারে।
হাইপারথাইরয়েডিজম
হাইপারথাইরয়েডিজম রোগে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড বেশি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে পড়ে। থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতার ফলে প্রচণ্ড গরম লাগা, হাত-পা ঘামা, পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, খাওয়ার রুচি স্বাভাবিক বা বেড়ে যাওয়ার পরও ওজন কমে যাওয়া, ঘন ঘন পায়খানা হওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া হার্ট ও ফুসফুসীয় সমস্যা যেমন বুক ধড়ফড় করা, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, হার্ট ফেইলিওর বা বুক ব্যথাও দেখা দিতে পারে। এছাড়া স্নায়ু ও মাংসপেশির সমস্যার কারণে অবসন্নতা বা নার্ভাসনেস, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, উত্তেজনা, আবেগপ্রবণতা বা মানসিক বিষাদগ্রস্ততা দেখা দিতে পারে। এর সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা কাঁপা, মাংসপেশি ও চক্ষুপেশির দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। এছাড়া হাড়ের ক্ষয় বা অস্টিওপরোসিস, মাসিকের সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত হতে পারে।
হাইপারথাইরয়েডিজমের চিকিৎসা হচ্ছে অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধ। যেটি থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতাকে কমিয়ে দেবে। এছাড়া কখনো কখনো সার্জারি করা প্রয়োজন হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধ ব্যবহার করা হলে তা দেড়-দুই বছর ব্যবহার করা হয়। তারপর এ ওষুধ গ্রহণ বন্ধ করে দিতে হবে। এরপর রোগী যদি স্বাভাবিক থাকে, খুব ভালো কথা, কিন্তু যদি আবারো রোগ ফিরে আসে তবে সাধারণত রেডিও আয়োডিন দিয়ে গ্ল্যান্ড নষ্ট করে দিতে হয়।
হাইপোথাইরয়েডিজম
হাইপোথাইরয়েডিজম মূলত নিম্নলিখিত কারণে দেখা যায়। যেসব অঞ্চলে আয়োডিনের অভাব রয়েছে, সেখানে আয়োডিনের অভাবের কারণে হাইপোথাইরয়েডিজম দেখা যায়। এছাড়া অটোইমিউন হাইপোথাইরয়েডিজম হলে থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি সক্রিয় হলে গ্ল্যান্ড নষ্ট হয়ে যায় এবং থাইরয়েড গ্ল্যান্ড কাজ করে না। চিকিৎসার কারণেও এ অসুখ হতে পারে। অপারেশনের কারণে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড বাদ দিতে হলে বা অন্য কারণেও থাইরয়েড নষ্ট হয়ে গেলে এ সমস্যা হতে পারে। হাইপারথাইরয়েডিজমের ওষুধের ডোজ বেশি হলে তার থেকে হাইপােথাইরয়েডিজম হতে পারে। নবজাতক শিশুদের মধ্যে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড তৈরি বা কার্যকর না হলে কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজম দেখা যায়।
হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে বেশকিছু লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন অবসাদগ্রস্ত হওয়া, পাশাপাশি অলসতা, ঘুম ঘুম ভাব। ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়া, শরীর অল্প ফুলে যাওয়া, ক্ষুধামান্দ্য শুরু হওয়া, চুল পড়তে শুরু করে। তাছাড়া স্মৃতিশক্তি কমে যায়, শীত শীত ভাব দেখা যায়, কোষ্ঠকাঠিন্য শুরু হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ফলে রক্তচাপ বাড়তে পারে বা মাসিকের সমস্যা হতে পারে, বন্ধ্যাত্বও দেখা দিতে পারে, গর্ভধারণকালে গর্ভপাত হতে পারে। কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজমে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ হয় না।
থাইরয়েড ক্যান্সার
থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অংশ টিউমারের মতো ফুলে উঠলে বলা হয় থাইরয়েড নডিউল। এসব থাইরয়েড নডিউলের ১ শতাংশ থেকে থাইরয়েড ক্যান্সার হতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অংশের কোষসংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেলে তাকে থাইরয়েড ক্যান্সার বলে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি বা এর অংশবিশেষ ফুলে ওঠা মানেই কিন্তু ক্যান্সার নয়। থাইরয়েড ক্যান্সার হলে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সেগুলো হলো গলার সম্মুখভাগ ফুলে ওঠা, ফোলা অংশটি বেশ শক্ত হয়ে যাওয়া, একটি বা একাধিক টিউমার হতে পারে। দুই পাশে টিউমার হতে পারে, আশপাশের লিম্ফনোডগুলো ফুলে উঠতে পারে। ওজন কমে যায়, খাওয়ার রুচি কমে যেতে পারে, গলার স্বর পরিবর্তন হতে পারে, গলার স্বর মোটা বা ফ্যাসফেসে হতে পারে। তবে থাইরয়েড নডিউল বা ক্যান্সার ছাড়াও গলার সামনে ফুলে উঠতে পারে। শ্বাসনালির ওপর চাপ সৃষ্টির ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
পরিবারে কারো থাইরয়েড ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের জন্য অবশ্যই এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বা হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। থাইরয়েড ক্যান্সার এমন একটি রোগ, যা সময়মতো চিকিৎসা করলে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ আরোগ্য পাওয়া সম্ভব।
তবে বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন থাইরয়েড গ্ল্যান্ড মানব শরীরে প্রধান বিপাকীয় হরমোন তৈরিকারী গ্ল্যান্ড। শিশুদের ক্ষেত্রে হরমোনটি শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বড়দের ক্ষেত্রে প্রজননে অক্ষমতা, নারীদের মাসিকের সমস্যা, পেটের সন্তান নষ্ট হওয়াসহ এ রোগে নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে। গর্ভকালে মায়ের হাইপোথাইরয়েডিজম থাকলে সন্তান বোকা ও বুদ্ধিহীন হতে পারে।
লেখক: ডা. শাহজাদা সেলিম , সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ।
জুলাই ২২, ২০২৩ এজি