Home / বিশেষ সংবাদ / নির্বাচনে বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসবে কে ? চিন্তা ভিনদেশের !
HASAN-ALI

নির্বাচনে বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসবে কে ? চিন্তা ভিনদেশের !

এ বছরের শেষের দিকে কিংবা আগামি বছরের প্রথম দিকে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে রাজনৈতিক দলগুলো দিন দিন সক্রিয় হতে শুরু করছে। নেমে পড়ছে রাজপথেও। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো সম্ভাব্য সব শান্তিপূর্ণ ও আইনানুগ পন্থায় মাঠে নামবে- তাদের দাবি-দাওয়া জনগণের সামনে তুলে ধরবে এবং এভাবেই জনমতকে তাদের পক্ষে আনতে প্রয়াস পাবে।

এ নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিবিদ ছাড়াও বুদ্ধিজীবী,পেশাজীবী সহ সচেতন মহলতো বটেই বিদেশীরাও আগ্রহ ও ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন বললে অত্যুক্তি হবে না। তারা বেশ কিছু আগে থেকেই আমাদের নির্বাচনে তাদের স্পর্শকাতরতা ও আশা-আকাঙ্খার বিষয়ে বলাবলি করে আসছেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমাদের নির্বাচনের বিষয়ে নানান ধরনের উপদেশ শুনাচ্ছেন। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় কারা আসবে কিংবা ক্ষমতায় থাকবে বা না থাকবে তা নিয়ে অনেকটা সজাগ রয়েছেন। যা সচেতন মহলের জোড়ালো ধারনা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার সময় (১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২) নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন,‘ কোনো দল অংশগ্রহণ না করলে তার দায় ‘ইসি’ নেবে না। এ ধরনের ঘোষনা ইতিবাচক দায়িত্বশীলতার প্রকাশ পায় না বরং অহমিকামূলক ও একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ‘ইঙ্গিত-স্বরূপ’। সাংবিধানিক পদগ্রহণকারী সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গের নিকট জাতি আরো ইতিবাচক-দায়িত্বশীল ও গ্রহণযোগ্য বক্তব্য আশা করে। তিনি যে কথাটি বললে হয়তো গ্রহণযোগ্য ও ভালো হতো তা হলো, নির্বাচনের সমতল ময়দান (খবাবষ ভরবষফ) এবং নিরাপদ-নিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টির পরও কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিতে ব্যর্থ হলে তার দায়তো সংশ্লিষ্ট দলকেই বহন করতে হবে। ‘ইসি’র এভাবে বলার সীমাবদ্ধতা যদি থাকে তবে তাকে সদিচ্ছার ঘাটতিরই বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই পর্যবেক্ষকরা দেখছেন।

নির্বাচন কমিশনের অবস্থান, তাদের কথাবার্তা, ক্ষমতাসীনদের মনোভাব এবং দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার মূখে,দেশের বাইরেও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মনোযোগের সৃষ্টি হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীলতা দেখাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অনুসারী পশ্চিমা দেশগুলো। আগে পশ্চিমারা ‘সন্ত্রাস’ নামক অস্ত্র ব্যবহার করতো ভিন দেশে হস্তক্ষেপ করার জন্য। সেই অস্ত্র এখন অকেজো প্রায়। তাই এখন তারা ‘মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ নামক উছিলা ব্যবহার করছে অন্য দেশে হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয়ার জন্য। তারা বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই চীনের উত্থান মোকাবেলায় এবং মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে অবাধ ও মুক্ত চলাচলের জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) ধারনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল।

আবার দক্ষিণ এশিয়া থেকে ভারত মহাসাগরে প্রবেশপথ বঙ্গোপসাগরের তীরে রয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। বস্তুত এবং বাস্তবতায় বেশ অনেক দিন ধরে অনেকটা চীনের ছায়াতলে থাকায় বাংলাদেশ মার্কিনদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব হয়ে উঠেছে। এদিকে বাংলাদেশ সরকার চীন ও ভারতের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি করে এলেও মার্কিন প্রশ্নে চীনের আশ্রয় নেয়ার বাস্তবতা অনেকটা দৃশ্যমান হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অন্যদিকে ভারত-চীনের বৈরিতা এবং ভারত-মার্কিন সুসম্পর্ক বিদ্যমান। তা ছাড়া ভারতের নিজস্ব-সামর্থ্য, কূটনৈতিক-দক্ষতা, আত্মনির্ভরতা, নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহসিকতা এবং এমনকি বৈশ্বিক রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানের কারণে চীন প্রশ্নে ভারতের বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রের কোন পিছুটান নেই। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে চীনের অর্থনৈতিক,কূটনৈতিক ও উন্নয়নবিষয়ক সম্পর্কের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।

উদাহরণ কল্পে বলা যায়, অন্য দেশের রাজনীতিতে চীন সাধারণত কোনো হস্তক্ষেপ না করলেও দেখা গেছে,বাংলাদেশে গত ২০১৮ সালের নির্বাচনটি সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ প্রশ্নবিদ্ধ মনে করলেও চীন সরকার তাৎক্ষণিকভাবে উক্ত নির্বাচনে জয়ীদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এর পর থেকে চীন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পর্ক গভীরে নিয়ে যায়।এভাবে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের নিয়ে চীন ও মার্কিন রাষ্ট্রের মধ্যে একটা অনানুষ্ঠানিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। তাই মার্কিনরা বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ও গণতন্ত্র অনুশীলনের নেতিবাচক দিকগুলোকে পুঁজি করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সরব হতে থাকে।

উল্লেখ্য, রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইউরোপের মাধ্যমে ইউক্রেনের ‘প্রক্সিওয়ার’ যথেষ্ট কিন্তু চীনকে ঠৈকাতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার। কারণ ভারত এমনিতেই চীনের প্রতি বৈরী। জাপানের সাথে চীনের রয়েছে চলমান ঠান্ডা লড়াই। এমতাবস্থায় মার্কিন নেতৃত্ব বাংলাদেশের ক্ষমতায় এমন কাউকে দেখতে চায় যারা চীনের আশীর্বাদপুষ্ট নয় কিংবা আশীর্বাদ পেতে চায় না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের তল্পিবাহক হবে। সেই লক্ষ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে তাদের তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দুতে সামনের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে রেখেছে।

বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে যার ফলে বৈশ্বিক মেরুকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এ মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো এবং রুশ-চায়না জোট এই দুই ব্লকের উভয়ই বাংলাদেশকে নিজেদের পক্ষে চাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এ দেশের ক্ষমতায় যারা থাকবে তারাই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে। আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা ভৌগলিক ও উন্নয়নগত কারণে চীন-ভারতের দিকে ঝুঁকে আছে এবং চীন-ভারতও সহযোগিতা করে আসছে।

কাজেই মার্কিনীরা মরিয়া হয়ে উঠছে নতুন একটি সরকার ক্ষমতায় আনতে যারা চীনের বলয়ের বাইরে থাকবে। এ ছাড়াও বললে বলতে হয়,আমরা উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় উন্নত দেশগুলো আমাদের উন্নয়নের অংশীদার হওয়ায় তাদের স্বার্থের বিষয়টিও এখানে জড়িত থাকে। যেমন জাপান আগে কখনও কিছু না বললেও সম্প্রতি তারা মার্কিন সুরের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের নির্বাচন সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করছে। গত ডিসেম্বরে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছিল। অর্থাৎ চীন ও রাশিয়ার অবস্থান বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অনুকূলে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। আবার পশ্চিমাদের অবস্থান ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে প্রতিয়মান হচ্ছে বলে অনেক বিশ্লেষকরা মনে করে।

এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক সংশয় তৈরি হচ্ছে দৃশ্যপটে তাই মনে হচ্ছে। এ দিকে চীন ও ভারতের বক্তব্যের পর ক্ষমতাসীনদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় আবার পশ্চিমাদের মন্তব্যের পর সরকার-বিরোধীরা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এভাবে দেশের উপর এক গভীর অনিশ্চয়তা ভর করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ে যার যার অবস্থানে অনড়। বস্তুতঃ দেশটা আমাদের। রুশ-মার্কিন বা চীন-ভারতীয়রা তাদের স্বার্থই দেখবে, আমাদেরটা নয়। দেশ আমাদের নির্বাচন আমাদের। কিসে দেশ ও জাতির মঙ্গল তা আমাদের উভয়পক্ষের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে অনুধাবন করতে হবে। নির্বাচন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং বিজয়ী হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মো.হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা, চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা, সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

তথ্য-সহায়ক গ্রন্থ :

১. বাংলা একাডেমি (পত্রিকা ৬৫ বর্ষ ঃ ৩য় সংখ্যা, জুলাই- সেপ্টেম্বর ২০২১)-পৃঃ ৪৩-৪৪
২. ঞধষঁশফবৎ গধহরৎুুঁধসধহ, চড়ষরঃরপং ধহফ ঝবপঁৎরঃু ড়ভ ইধহমষধফবংয, উযধশধ, ১৯৯৪, চ-৮০
৩. ওহঃবৎহধঃরড়হধষ জবষধঃরড়হ ধহফ ইধহমষধফবংয, ঐধৎঁহ-টৎ-জধংযরফ, উযধশধ, ঞযব টহরাবৎংরঃু চৎবংং খঃফ. ২০০৪, চ-২১৬
৪. নয়া দিগন্ত, ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, পৃঃ ৬
৫. কালের কণ্ঠ, ৯ মে ২০২২, পৃঃ ৬
৬. নয়া দিগন্ত, ঢাকা, ৩ এপ্রিল ২০২৩, পৃঃ ৭