স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও থানা/উপজেলা পর্যায়ে পাবলিক লাইব্রেরি বা গণগ্রন্থাগারের বিস্তার ঘটেনি। ইউনিয়ন তো দূরের কথা। অবকাঠামো ও বৈষয়িক উন্নতিতে আমরা ঈর্ষণীয় সাফল্য পেলেও মানসিক উৎকর্ষে পিছিয়ে।
‘দিন বদলের হাতিয়ার, হতে পারে গ্রন্থাগার’,একথা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। গ্রন্থাগার হতে পারে সব সাংস্কৃতিক মানসিক উন্নয়নের ‘প্রাণকেন্দ্র’, এর তাৎপর্য অনুধাবনে আমরা ব্যর্থ। সময় এসেছে, প্রতিটি গ্রামে গ্রন্থাগার বিনির্মাণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের। প্রসার ঘটাতে হবে জ্ঞানচর্চার, এর বিকল্প নেই।
বছর ঘুরে এসেছে ৫ ফেব্রুয়ারি। গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারপ্রেমিদের প্রিয় ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’। ২০১৭ সালের ৭ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাধারণ অধিশাখা একটি পরিপত্র জারি করে। তার মর্মার্থ,সরকার ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ঘোষণা করেছে এবং এ তারিখকে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ হিসেবে উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন সংক্রান্ত পরিপত্রের ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত পরিপালনের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়/বিভাগ/ সংস্থাকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়।
চলতি বছর জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের প্রতিপাদ্য ‘স্মার্ট গ্রন্থাগার, স্মার্ট বাংলাদেশ’। ২০২২ সালে প্রতিপাদ্য ছিল, ‘সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার, ডিজিটাল গ্রন্থাগার’। ২০২১ সালে, ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, ঘরে ঘরে গ্রন্থাগার’। ২০২০ সালে, ‘পড়ব বই গড়ব দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’।
২০১৯ সালে, ‘গ্রন্থাগারে বই পড়ি, আলোকিত মানুষ গড়ি’ এবং ২০১৮ সালে, ‘বই পড়ি, স্বদেশ গড়ি’। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের আলোকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো একযোগে দিবসটি উদযাপন করে থাকে।
একটি কথা না বললেই নয়। তা হলো- উপর থেকে চাপিয়ে না দিলে আমাদের দেশে কোনো কাজ হতে চায় না। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে (স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা)‘একাডেমিক গ্রন্থাগার’ স্থাপন ও পরিচালনার বিষয়টি তেমনই একটি। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে (স্কুল-মাদরাসা-কলেজ) ‘একাডেমিক বা শিক্ষায়তন’ গ্রন্থাগার চালু হয়েছে, তবে সব প্রতিষ্ঠানে নয়।
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে নামকাওয়াস্তে, বাস্তবে কার্যক্রম নেই। সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে বহু প্রতিষ্ঠানে এ কথার সত্যতা মিলবে। দেখা যাবে, গ্রন্থাগার ব্যবহার করা হচ্ছে গুদাম ঘর বা পিয়ন-দারোয়ান-গার্ডের থাকার কক্ষ হিসেবে। কিছু বই হয়তো আছে কিন্তু রাখা হয়েছে টয়লেটের পাশে চিপাগলি বা করিডোরে। গ্রন্থাগারিক আছেন, তিনি ব্যস্ত অন্য শিক্ষকের প্রক্সি ক্লাসে কিংবা তাকেও হয়তো ‘ক্লাস’ দেয়া হয়েছে। ‘তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা’ রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও তা উপেক্ষিত।
একথা ভুলে গেলে চলবে না, পাঠক তৈরির প্রধান ক্ষেত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই একাডেমিক বা শিক্ষায়তন গ্রন্থাগার চালু কার্যকর রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থাগারিকের উপযোগিতা উপলব্ধি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।
মাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে দশম) ও উচ্চ মাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ) স্তরে সহকারী গ্রন্থাগারিক/ক্যাটলগারের পদ সৃষ্টি করা হয়। পদটি এমপিওভুক্ত। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সমমানের ইবতেদায়ী মাদরাসায় এ পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে কাক্সিক্ষত ফল অর্জিত হচ্ছে না। অর্থাৎ ‘পাঠক’ তৈরি হচ্ছে না। আমরা এই স্তরে গ্রন্থাগারিকের পদ সৃষ্টির জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীকে অনুরোধ করছি।
জানা মতে, দেশে সরকারি, বেসরকারি, কিন্ডারগার্টেন ও এনজিও পরিচালিত সব মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় ১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি। তার মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার।
১৯৭২ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ৭ হাজার ৭৯১টি, বর্তমানে ২০ হাজার ৮৪৯টি। কলেজ ছিল ৫২৬টি,বর্তমানে ৪ হাজার ৬৯৯টি। বর্তমানে আলিয়া ও দাখিল মাদরাসা আছে ৯ হাজার ৩০৫টি। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১৫৮টি।
গ্রন্থাগারিকরা নিজেদের পদটিকে ‘যুৎসই’ মনে করেন না। তাদের বক্তব্য প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহকর্মী ও সাধারণ মানুষ গ্রন্থাগারিককে যথাযথ সম্মান করে না। তাই তারা হীনমন্যতায় ভোগেন। দাবি তোলেন পদবি পরিবর্তনের। আন্দোলনেও নামেন। সরকার দাবি মেনে নেয়। ২০২১ সালের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় নতুন পদবি দেওয়া হয় ‘সহকারী শিক্ষক (গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান)’।
এতে সুবিধা হলো এ যে, গ্রন্থাগারিকরা লাইব্রেরির কাজ না করে বছরব্যাপী অন্যান্য বিষয়ের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কমিটি বা প্রতিষ্ঠান প্রধান তাদের ‘শ্রম ও মেধা’ ভিন্ন কাজে ব্যবহার অপচয় করেন। বিষয়টি দেখার বা যথাযথ তদারকির কেউ নেই। পুরস্কার হিসেবে ‘বই’ এর জুড়ি নেই।
একথা আমরা জানি, কিন্তু মানি না। প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই প্রদানের তাগিদ দিয়েছে সরকার। ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল ‘মাউশি’ পরিচালক স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়,‘লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিদ্যালয়গুলোর সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রতিযোগীদের মধ্যে পুরস্কার হিসেবে ক্রোকারিজ সামগ্রী প্রদান করা হয়। এ ধরনের পুরস্কার শিক্ষার্থীদের শিখন শেখানোর কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এ প্রেক্ষিতে গুণগত শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে সব অনুষ্ঠানে প্রতিযোগী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার হিসেবে বয়স উপযোগী, মানসম্মত বই অথবা শিক্ষাসহায়ক উপকরণ প্রদান করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হলো। তবে সে নির্দেশনাটি কতটা পালন করা হচ্ছে তা সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি ও বেরাইদ গণপাঠাগার।
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur