বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি । এদেরকে বলা হয় বাংলা ভাষার সাহিত্যের সম্রাট। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ রচনা গীতাঞ্জলি আর নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা বিশ্বে বাংলা ভাষাকে সুমহান আসনে নিয়ে গেছে। বাঙালী জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষাকে আরোও এক ধাফ এগিয়ে দেন। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলির শতবর্ষ অতিবাহিত হয়েছে আর ২০২২ সালে বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ চলছে।
বাংলা সাহিত্যেও এ দু’কবি বিশ্বে কবি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলী লিখে আর বাংলাদেশের জাতীয়কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবিতার মাধ্যমে সর্বপ্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা চান।
বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৮-১৯০৯ সালে বাংলা ভাষায় এ গীতাঞ্জলি লেখা শুরু করেন ।বেশিরভাগ গীতকবিতা ও গানগুলো রবীন্দ্রনাথের নিজের সুরারোপ এবং ব্রাহ্ম-ভাবাপন্ন ভক্তিমূলক রচনা ছিল। প্রথমেই ১৯১০ সালে বাংলা ভাষায় প্রকাশ হয়। এরপর তিনি ও ইংরেজ কবি ম্যাক মিলান সর্বপ্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ১৯১২ সালে ।
বিশ^কবি রবীন্দ্র ঠাকুর প্রথম ইংরেজি অনুবাদটি তাঁর শিল্পী বন্ধু ইংল্যান্ডের রোদেনস্টাইনকে পড়তে দেন। তিনি তা পড়ে অবিভূত হয়ে যান। পরে রোদেনস্টাইন প্রখ্যাত ইংরেজ কবি ইউলিয়াম বাটলার ইয়েটসকে দেন। এর পরবর্তীতে কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস ইংরেজিতে অনুবাদ করে এর নাম দেন ‘ সংস অফারেরিং তবে কেউ কেউ বলেছেন-বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই গীতাঞ্জলি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস গীতাঞ্জলির ১৬ পৃষ্ঠার একটি ভূমিকাও রচনা করেন। লন্ডনে ১৯১২ সালে গীতাঞ্জলি প্রথম ইংরেজিতে সংস্করণ করেন ইন্ডিয়ান সোসাইটি। এটির ইংরেজিতে অনুবাদ কফি ৭৫০ টি ছাপানো হয়। বিক্রির জন্য রাখা হয়েছিল ২৫০ কপি। পাঠক চাহিদার কারণে ১৯১৩ সালে আরো ১৩ বার ছাপানো হয়েছিল। তবে সংখ্যা কতটি তা জানা যায় নি।
কবি ম্যাক মিলানসহ উভয় কবি গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে রবীন্দ্রনাথকে পাশ্চাত্য জগতে পরিচিত করেন। এর পর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটি সুইডিশ নোবেল কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছিলেন ইংরেজ কবি ম্যাক মিলান। সুইডিশ নোবেল কমিটি ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা দেন। বিশ^ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলি যখন লিখেন তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৫২ বছর।
প্রখ্যাত কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি কাব্য উৎসর্গ করেন। ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বও যখন তিনি গীতাঞ্জলি রচনার জন্যে বিশ্ব বিখ্যাত সবচেয়ে সম্মানিত নোবেল পুরস্কার পান তখন তিনি জোড়াসাকোর বাড়িতে অবস্থান করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আগে দীর্ঘদিন ভ্রমণে কাটিয়েছেন বিভিন্ন দেশে। দেশে ফেরার কিছুদিন পর তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন বেশ কয়েকজন বিদেশি ও প্রবাসী বন্ধু।
তাদেরকে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বাহিরের বেড়োনের- ঠিক সে সময়ে স্থানীয় ডাকবিভাগের একজন তাঁর হাতে তুলে দিলেন টেলিগ্রামটি। তিনিই প্রথম এশিয়ার নোবেল বিজয়ী ব্যক্তি। বিশ্ব বিখ্যাত অনেক কবি ও সাহিত্যিকগণ নোবেল পুরস্কার পাননি। এর বেশীরভাগ গীতকবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথের নিজের সুরারোপ এবং এগুলো ব্রাহ্ম-ভাবাপন্ন ভক্তিমূলক রচনা ছিল।
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দ্বারা সন্মানিত হওয়ার সুবাদে এশিয়া মহাদেশের জ্ঞানী ও সন্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম নোবেল পুরস্কার জয়ের একমাত্র গৌরব অর্জন করেন। অথচ মহাত্মা গান্ধী, টলস্টয়, শেক্সপিয়ার, ফেরদৌস, হাফিজ, রুমি, টমাস হার্ডি, এমিল জোলা,কাফকা, চেখভ, উর্মিলা লরেন্স, ব্লাদমির,সার্ভান্তেস, দস্তয়েভস্কি, ইবসেন, হোর্হে লুই,জেমস জয়েজ, মার্সেল, বেথেলহেম, ভার্জিনিয়া উলফ ও লরেন্স প্রমুখ বিশ্ব বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকরা নোবেল পুরস্কার পান নি। কিন্তু তাঁদের রচনায় তাঁরা বিশ্বে অমর হয়ে আছেন। কবিগুরুর সৃষ্ঠিশীল প্রতিভারগুণে গীতাঞ্জলি লিখে তিনি নোবেল পুরস্কার পান ।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এ যে- গীতাঞ্জলি’র পুরস্কার হিসেবে পাওয়া নোবেল পুরস্ক্রটি ২০০৪ সালের ২৪ মার্চ দিবাগত রাতে শান্তিনিকেতন থেকে চুরি হয়ে যায়। আবার তিনি ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপরেশন ( বিবিসি)’র রির্পোট অনুযায়ী তাঁেক দ্বিতীয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পরেই তাঁর নামটি ঘোষণা করেন। বিশ্বব্যাপি অনেক খ্যাতিমান ও প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব নোবেল পুরস্কার পাননি। অথচ বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলি কাব্য লিখে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ।
রবীন্দ্রনাথের (১৯৬১-১৮৪১) ৮০ বছরের জীবদ্দসায় ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্য সংকলন তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। সবমিলিয়ে তাঁর ৯৫টি ছোটগল্প, ২, ১৭৪ টি গান ও ২,২৬৬ টি কবিতা লেখেন্। যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়াও তিনি প্রায় ২ হাজারেরও বেশি ছবি অঙ্কন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনাগুলো বিশ্বের বহু ভাষায় অনূবাদিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ বিশ্ববরেণ্য মহান মানুষটি ছিলেন একাধারেএকজন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক,সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার,চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী, দার্শনিক সমাজসংস্কারক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক বলিলেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি পৃথিবীর ৩০টি দেশ ভ্রমণ করেন ।
জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র শতবর্ষ :
আমাদের প্রিয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত এবার ২০২১ সালের ডিসেম্বরের শেস সপ্তাহে রচিত বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষপূর্ণ হলো ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি। নজরুল ইন্সিটিটিউড এ বছরকে ‘ বিদ্রোহীর শতবষ’ ঘোষণা করেছেন্।
এটি নজরুলের দেশকাঁপানো এ বিদ্রোহী কবিতা রচনার শতবর্ষ। এ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে পৃথিবী জুড়েই নজরুল প্রেমীরা নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করছেন। বৃটিশদের প্রায় দু’শ বছরের অত্যাচার, নিপীড়ন ও জর্জরিত জাতিকে শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জনের আহবান জানিয়েছেন কবি নজরুল। বিদ্রোহী কবিতাটি কবি নজরুল বাংরা ভাষায় লিখে সে সময়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়নের জবাব দেন।
একই সাথে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। যারা সব কিছু ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইছে তাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’।
বিদ্রোহী কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহ চেতনারই প্রকাশ ঘটেছে। তিনি বিদ্রোহ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে এবং শৃঙ্খল পরা আমিত্বের বিরুদ্ধে। পরাধীন ভারতবর্ষে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ছিল ধূমকেতুর মতো। পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে তরুণ সমাজকে সু-শৃঙ্খল হতে সহায়তা করেছিল বিদ্রোহী কবিতাটি। জীর্ণশীর্ণ ও দু’ শ বছরের একটি পরাধীন জাতিকে একটি স্বাধীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে বিদ্রোহী কবিতার ভূমিকা রয়েছে। তৎকালীন সময়ে বিদ্রোহী কবিতাটি কতটুকু চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না ।
১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে‘নবযুগ’পত্রিকায় প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে নজরুল আবহাওয়া জনিত কারণে কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। ফলে তিনি দেহঘরে বেড়াতে যান। এ সময়ে নজরুলের ঐ সময়ের একটি রচনাটি-মোসলেম ভারতে প্রকাশের জন্য আফজালুল হককে একখানা পত্রিকারের প্রকাশের কথা বলেন। কবি নজরুল ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে পাকিস্থানের করাচি থেকে সরাসরি কলকাতায় চলে আসেন। ফলে সর্বপ্রথম কলিকাতায় কমরেড মুজাফফর আহমেদের সাথে পরিচয় হয় এবং তাঁর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
বিদ্রোহী কবিতার রচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে জানা যায় ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাতে ৩-৪ সি তালতলা, কলকাতা-১৪ লেনের বাড়ির নিচ তলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ঘরে বসে শেষ রাতে নিবিড় পরিবেশে তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করার পর নামকরণ করেন ‘ বিদ্রোহী’। বিদ্রোহী কবিতাটি কবি নিজেই আবৃতি করে বন্ধ’ মোজাফ্ফরকে শোনান।
তাই প্রথম শ্রোতা তাঁর বন্ধু কমরেড মুজ্জাফর আহমেদই। কাজী নজরুল ইসলাম একশ’ বছর আগে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে (সম্ভবত: ২৪ ডিসেম্বর শেষ রাতে) কলকাতার মৌলালি অঞ্চলের কাছে ৩/৪ সি, তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে পেনসিলে রচনা করেন কালজয়ী এ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। বিদ্রোহী কবিতাটিতে ছোট-বড় ১৪ টি ছোট-বড় স্তবক, ১৪১ টি লাইন বা পংক্তি এবং ১৪৫ বার ‘আমি’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন। ‘আমি’ দ্বারা তিনি হয়তো বুঝাতে চেয়েছেন-ভারত বর্ষের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের প্রতিনিধি।
প্রথম প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বা বঙ্গাব্দ ১৩২৮ সালের ২২ পৌষ তারিখে। এরপর মাসিক ‘মোসলেম ভারত’পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় পত্রিকাটি অনিয়মিত হওয়ায় ১৩২৮ সালের কার্তিক মাসের পরিবর্তে মাঘ মাসে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবারও ছাপা হয়। এর সম্পাদক ছিলেন অবিন্যাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য।
বল বীর উন্নত মম শির ..
প্রকাশের পরের দিন কবি নিজেই বিজলী পত্রিকার ৪ টি কপি নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাকোঁর কুটিরে গিয়ে আবৃত্তি করে শুনান। এতে কবিগুরু অভিভূত হন এবং তিনি বলেন,‘ তুমি অনেক বড় কবি হতে পারবে। ’ সেই থেকে তাঁর নাম চারদিকে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে বিদ্রোহী কবি বলে স্বীকৃতিও লাভ করেন।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার এ পুন:পুন: প্রকাশনা তখনকার সময়ে পাঠক ও প্রকাশকের মধ্যে এর তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ বহন করে। একই বছর এটি মাসিক ‘প্রবাসী’এবং মাসিক‘বসুমতী’ এবং পরের বছর ১৩২৯ বঙ্গাব্দে মাসিক ‘সাধনা’য় পুন:প্রকাশিত হয়। পাঠক সংখ্যা ছিল ২ লাখেরও উপরে এবং ছাপা হয়েছিল ২৯ হাজার কপি।
কমরেড মুজাফফর আহমদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ আসলে বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বড়দিনের ছুটিতে। প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। তখন নজরুল ও আমি নিচের তলার পূর্ব দিকের বাড়ির নিচে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটিতে থাকি। কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন রাতে। রাতের কোন সময় -তা জানি না। রাত ১০ টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ’
বিদ্রোহী কবি তিনি কবিতার ভাষায় বলতে চেয়েছেন কারো অধীন হয়ে নয়-বরং আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাই মানুষের সার্থকতা। ভাব-ভাষা ও উপমা-ছন্দে বিদ্রোহী কবিতাটি রচিত এক অনবদ্য রচনা। বিদ্রোহী কবিতাটি যখন তিনি রচনা করেন-তখন ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল এবং এক উত্তাল হাওয়া বিদ্যমান ছিল। গোটা ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ছিল। এর মধ্যেই তার কালজয়ী রচনা‘বিদ্রোহী’। বিদ্রোহী কবিতা নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের ১২টি কবিতার একটি। ‘বিদ্রোহী’ এ কাব্যের দু’নম্বর কবিতা।
মোসলেম ভারত পত্রিকার সম্পাদক আজজালুল হক কবিকে অনুরোধ করলে তিনি তারঁ কাছে রাখা পেন্সিল দিয়ে লেখা কপিটি ছাপাতে দিয়ে দেন। কলকাতা ৩/৪ সি, তালতলা লেন,কলকাতা-১৪ বাড়িটি ছিল তখন ‘রাজেন্দ্র কুঠির’ নামে। পরে মালিকানা পরিবর্তন হয়ে হয় সীমা সাহার বাড়ি’। বর্তমানে ‘নজরুল স্মৃতি কক্ষ’ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে।
বাংলা কবিতা ও গানের ইতিহাসে এমন বলিষ্ঠ গান ও কবিতা আর রচিত হয়নি। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পরপরই নজরুলের কবিখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অবিভক্ত বাংলার শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতিতে ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। মাত্র ২২ বছর বয়সে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিরূপে যে খ্যাতি অর্জন করেন, হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এর নজির নেই। শতবর্ষী একটি কবিতাই এ আলোচনার বিষয়।
তাই সেকালের বাংলাভাষাভাষী কবি- সাহিত্যিকদের দাবির প্রেক্ষিতে ১৯২৯ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে তাঁেক ‘ বিদ্রোহী কবি ’ বা ‘জাতীয় কবি ’ হিসেবে সংবর্ধনা প্রদান করেন। প্রধান অতিথি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু এবং ভারতের তৎকালীন বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন অনুষ্ঠানের সভাপতি। বস্তত: এ কবিতার জন্ম বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত সাড়া জাগানো ঘটনা।
পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকা, ব্রিটিশরাজের অনুগ্রহ-প্রত্যাশী বাঙালি জাতিকে নজরুল এ কবিতার মাধ্যমে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলেন। বিশেষ করে মুক্তিকামী বাঙালি তরুণ সমাজের কাছে এ কবিতা ছিল রক্তে উন্মাদনা সৃষ্টিকারী,হৃদয়ে অগ্নি-প্রজ্বলনকারী এক বজ্রকঠিন ধ্বনি। কবির রচিত অগ্নীবীণা কাব্যগ্রন্থে বিদ্রোহী কবিতাটি অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে। চলতি ২০২২ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী রচনা ‘বিদ্রোহী ’কবিতার শতবর্ষ পূর্তি।
বাংলাদেশের জাতীয়কবি কাজী নজরুল ইসলাম-বিদ্রোহী কবি হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিতি সাহিত্য চর্চার দিনগুলোতেই পান। তাঁর এ বিশেষ বিশেষণ টি তাঁর নামের সাথে সংযুক্ত হয়‘ বিদ্রোহী কবিতা’ রচনার মধ্য দিয়ে ।
এ ছাড়াও তিনি কলকাতায় ফিরে গিয়েই রচনা করেন তাঁর ঐতিহাসিক ‘ভাঙার গান’- কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল- কবিতা টি লিখেন । বাংলা কবিতা ও গানের ইতিহাসে অমন বলিষ্ঠ গান ও কবিতা আর রচিত হয়নি। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পরপরই নজরুলের কবি খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অবিভক্ত বাংলার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। বিদ্রোহী কবিতাটি ৩৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটি এবার ভারতীয় উপমহাদেশের ১শ ’টি ভাষায় অনুবাদের আয়োজন চলছে। শতবর্ষ উপলক্ষে নজরুল ইনস্টিটিউট ‘ বিদ্রোহর শতবর্ষ ’ নামে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছে।
১৯২০ সাল হতে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তাঁর সব রচনা সামগ্রীর সঠিক হিসেব পাওয়া না গেলেও ২ হাজার ৮ শ গান, ৯শ কবিত, ১শ টি প্রবন্ধ, ৫৫ টি গ্রন্থ, ২৫টি নাটক, ১৮ টি গল্প, ১ শ ৯৪ গজল ও ইসলামী গান ও ৪৫০ টি শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেন। এর মধ্যে নার্গিসদের বাড়ি অবস্থান কালে ১২০টি কবিতা ও ১৬০টি গান লিখেছেন্ ।
বাংলা ভাষার সাহিত্য গগনে আর কোনো বাংলা ভাষার কবি বা সাহিত্যিক ২৩ বছরের এ অল্প সময়ে এতগুলো রচনাবলী কেউ রেখে গেছেন।
তিনি বাংলা সাহিত্য,কবিতায় সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ দু’ বাংলাতেই তাঁর কবিতা,গান ও গজলে সমানভাবে সমাদৃত। ২২ বছর বয়সে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিরূপে যে খ্যাতি অর্জন করেন, হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এর নজির নেই। তিনি চিকিৎসার জন্যে ইংল্যান্ড,ভিয়েতনাম, জার্মানী ও রাশিয়া যান।
শতবর্ষ উপলক্ষে নজরুল ইনস্টিটিউট ‘বিদ্রোহী’ নামে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপরেশন ( বিবিসি)’র রির্পোট অনুযায়ী তাঁেক ‘৩য় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ও বিশ^কবির পরেই তাঁর নামটি চলে আসে ।
তথ্যসূত্র : রতনতনু ঘোষ রচিত‘ রবীন্দ্র ও নজরুল সম্পর্ক,মো.হাবিবুর রহমান রচিত ‘ছোটদের নজরুল,‘ নবারূণ ও বাংলাদেশ সচিত্র মাসিক পত্রিকা,শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত-‘নজরুল জীবনের ট্য্রাজেডি’,ডা.আনিস আহমেদের সম্পাদনায়‘কাজী নজরুলের জীবনী এবং ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত ছবি )
লেখক : আবদুল গনি,শিক্ষক, লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী,চাঁদপুর টাইমস ও সাধারণ সম্পাদক, নজরুল গবেষণা পরিষদ, চাঁদপুর। ৩ নভেম্বের ২০২২। ফোন : ০১৭১৮-২১১ ০৪৪ ।