খন্দকার রাশেদুল হক সংগীত ভুবনে যিনি মিল্টন খন্দকার নামে খ্যাত। যাঁর হাত ধ’রে খ্যাতিমান হয়েছেন এ দেশের বহু কণ্ঠশিল্পী।
আগমন ঘটেছে বা ডেব্যু অ্যালবাম করেছেন শতাধীক শিল্পীর।
আধুনিক বাংলাগান এবং অডিও শিল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া পাইনিয়রদের একজন বলা হয় তাঁকে।
তাঁর কথা ও সুরে ( অডিও অ্যালবাম, চলচ্চিত্র, নাটক, টেলিভিশন, বেতার ) এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে চার সহস্রাধিক গান। তার মধ্যে একক অ্যালবাম-ই দুইশতাধীক।
নবাগত শিল্পীদের পাশাপাশি তাঁর গানে সমানতালে কণ্ঠ দিয়েছেন- বাংলাদেশ ও মুম্বাইয়ের উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল শিল্পী। কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৫ সালে প্রযোজক সমিতির বিচারে “বিশ্বপ্রেমিক” ছবির গানে ও ২০১২ সালে শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে পেয়েছেন- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং দেশের বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক সংবর্ধনা ও সম্মাননা।
নতুন গীতিকারদের গান লেখার কলা-কৌশল শেখানোর জন্য তিনি ১৯৯৭ সালের ১ ডিসেম্বর রাজধানীর রামপুরাতে ‘গীতিকাব্য চর্চা কেন্দ্র’ নামে একটি স্কুল খোলেন; নিজ খরচে যা চালাচ্ছেন গত ২৫ বছর ধ’রে।
গুণী এই সংগীত ব্যক্তিত্ব ১৯৬৭ সালের ২৫ জুন জন্মগ্রহণ করেন- কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া’য়। ওখানেই তাঁর পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা। পরবর্তীতে ঢাকার মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডে অবস্থিত সরকারি সংগীত কলেজের ছাত্র ছিলেন বেশ কিছুদিন। ছাত্রাবস্থায়ই বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরকারি চাকুরি এবং অডিও শিল্পে গীতিকার ও সুরকার হিসেবে কম বয়সেই খ্যাতিমান হয়ে উঠার কারণে- সংগীত কলেজের পড়াশোনাটা অসমাপ্তই রয়ে যায় তাঁর। পুলিশ অফিসার বাবার ৮ ছেলে ও ১ মেয়ে সন্তানের মধ্যে মিল্টন খন্দকারের অবস্থান ৬ষ্ঠ।
সংগীতে পথ চলা কীভাবে জানতে চাইলে তিনি জানান- ‘শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় কুষ্টিয়ার ঐতিহ্য শত শত বছরের। আমাদের শৈশব-কৈশোরে কুষ্টিয়া শহরের পাড়া-মহল্লায় নানান রকমের সংগঠন ছিলো। সেইসব সংগঠনে নিয়মিত চলতো- খেলাধুলা, ছবি আঁকা, নাচ, গান, কবিতা, অভিনয় মোটকথা সৃজনশীল সকল কর্মকান্ডের চর্চা। এসব দেখে দেখে আমিও জড়িয়ে যাই সংস্কৃতি চর্চায়। মন ও মনন গ’ড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক আবহে।
শুরুতে গানের প্রতি নয়, অভিনয়ের প্রতিই ছিলো আমার প্রচন্ড ঝেঁক। স্কুলে পড়াকালিন- মহল্লার বড়ভাই ও কয়েকজন বন্ধু মিলে গঠন করি একটি নাটকের দল। দলটির নাম ছিলো- ‘বোধন থিয়েটার’। রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি বোধনকে ঘিরে। ধ্যানে-জ্ঞানে তখন শুধুই নাটক। আমার অন্য বন্ধুরাও তাই। সেই বন্ধুদের মধ্যে একজন হলেন- মাসুম রেজা। আজ যিনি বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় একজন নাট্যকার হিসেবে স্বীকৃত। মাসুমসহ আমরা প্রতিদিনই নিয়ম ক’রে নাটকের রিহার্সাল করি। হঠাৎ একদিন এক বড়ো ভাই বললেন, নাটকের জন্য কণ্ঠব্যায়াম টা খুবই জুরুরী। কণ্ঠব্যায়াম করার জন্য মহল্লারই একটি সংগীত সংগঠনে যোগাযোগ করি। সেখানে গান শেখাতেন- খন্দকার মিজানুর রহমান বাবলু। তিনি-ই আমার সংগীতের প্রথম ওস্তাদ। তাঁর কাছে গানের তালিম নিই কয়েক বছর। ওস্তাদের উৎসাহে- নাটক থেকে সংগীতের প্রতি ঝোঁকটা বেড়ে গেলো। এই ঝোঁকের কারণেই সংগীতে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসে সরকারি সংগীত কলেজে ভর্তি হই। সংগীত কলেজে ভর্তি হতে আমাকে সহযোগিতা করেন- আবু বকর সিদ্দিক। যিনি পরবর্তীতে ফোক শিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। আবু বকর সিদ্দিক-ই আমাকে নিয়ে যান সরকারি সংগীত কলেজের তৎকালিন শিক্ষক- বিখ্যাত নজরুলসংগীত শিল্পী খালিদ হোসেন এবং জহির আলিম স্যারের কাছে।
মহান এই শিক্ষকদ্বয়ের কাছে আমার চিরজীবনের কৃতজ্ঞতা। সংগীত কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরকারি চাকুরি হয়ে যায় আমার। গান ভালোবাসি এবং গানের মানুষ হিসেবে বিটিভি’র তৎকালিন ডিউটি অফিসার ( পরবর্তীতে জেনারেল ম্যানেজার ) গীতিকার শফিউদ্দিন শিকদার সাহেব ভীষণ স্নেহ করতেন আমাকে। উনার মাধ্যমে পরিচয় হয় হাসান চৌধুরীর সাথে। তাঁর কক্ষে প্রায়ই আড্ডা দিতে আসতেন হাসান চৌধুরী। তাঁরা ছিলেন বন্ধু। হাসান চৌধুরী তখন তাঁর প্রথম গানের অ্যালবাম করবেন করবেন এমন একটা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তো সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আমার বাসায় প্রায়ই হাসান চৌধুরী আসতেন। আমরা হারমোনিয়াম নিয়ে গানের আড্ডা দিতে দিতে কয়েকটি গান তৈরি ক’রে ফেলি মানে আমার কথা ও সুরে হাসান চৌধুরীর কণ্ঠে গানগুলো উঠাই। ঘটনাটাক্রমে পরিচয় হওয়ার পরে অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ( তখনো অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এতোটা বিস্তৃত হয়নি ) ‘বেতার জগৎ’ এর মালিক- আজিজুর রহমান কচি ভাইও প্রায়ই আমার বাসায় আড্ডা দিতে আসতেন। একদিন সন্ধ্যার পর এসে দেখেন- আমি ও হাসান চৌধুরী হারমোনিয়ামে নতুন নতুন গান তুলছি। কচি ভাই বললেন- আপনারা গানগুলো রেকর্ড ক’রে ফেলেন। সব খরচ আমি দেবো এবং আমার “বেতার জগৎ” থেকে আপনাদের অ্যালবাম রিলিজ করবো।
হাসান ও আমি খুশিতে নাচতে থাকি। পরের দিনই ঝংকার স্টুডিওতে চ’লে গেলাম গান রেকর্ডিং করাতে। ১২ টি গান সম্পন্ন করার পর কচি ভাইয়ের কাছে মাস্টার জমা দিই। কিছুদিন পর ‘সেই তুমি’ শিরোনামে রিলিজ হয় আমার ও হাসান চৌধুরীর প্রথম একক অ্যালবাম। অ্যালবামটি রিলিজের কয়েকদিন পরেই শুরু হয় ‘৮৮ এর বন্যা। সমগ্র বাংলাদেশ বন্যায় বিধ্বস্ত। আমাদের অ্যালবামটি মানুষের কাছে পোঁছানোর আগেই বিরাট ধাক্কা খেলাম। হাসান ও আমার ভীষণ মন খারাপ। আমাদের স্বপ্ন ভাঙার পাশাপাশি কচি ভাইয়ের আর্থিক ক্ষতি হয়ে গেলো। ভয়ে আমরা কচি ভাইয়ের আশেপাশে আর যাই না, কচি ভাইও আসেন না বললেই চলে। এভাবে কয়েকমাস যাবার পরে জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে এলো, আমরাও স্বপ্ন ভঙ্গের ক্ষত শুকিয়ে নতুন ক’রে আবার গান করবো নাকি করবো না- এই দোটানায় দুলছি। ছুটির দিনের একবিকেলে আমার বাসায় আগের মতো- আমি ও হাসান গানের আড্ডা দিচ্ছি; তখন বীনা নোটিশে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলেন কচি ভাইয়ের বাবা, উনার হাতে কয়েকটি মিষ্টির প্যাকেট। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরলেন। উনার চোখেমুখে ব্যাপক উচ্ছ্বাস।
কবির হোসেন মিজি,
চাঁদপুর টাইমস
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur