Home / চাঁদপুর / মেঘনার ভাঙনে বিলীন হবার শঙ্কা চাঁদপুর শহর
মেঘনার

মেঘনার ভাঙনে বিলীন হবার শঙ্কা চাঁদপুর শহর

পদ্মা, মেঘনা, ধনাগোদা ও ডাকাতিয়ার- এ চার নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে ইলিশের বাড়ি খ্যাত চাঁদপুর জেলা। নদীবিধৌত এ জেলার মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস নদীর মাছ এবং ডাঙার ফসল। এই উৎসে সবচেয়ে বেশি অবদান প্রমত্তা মেঘনার। অথচ এরপরেও বহুকাল ধরে এ নদীকে চাঁদপুরের দুঃখ বলা হতো। যার করাল গ্রাসে বসত ভিটা, জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন এ জেলার অসংখ্য মানুষ।

স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে নদী ভাঙনরোধে সরকার নানান উদ্যোগ গ্রহণ করে। নির্মাণ করা হয় শহররক্ষা বাঁধ। কিন্তু ভাঙনের মুখে এ বাঁধ এখনো তেমন স্থায়ী হয়নি। ফলে বর্ষা মৌসুম এলেই ভাঙন আতঙ্কে দিশেহার থাকে মেঘনান দুইপাড়ের বাসিন্দারা। যার ব্যত্যয় ঘটেনি এবারের বর্ষাতেও।

সম্প্রতি একদিকে বর্ষার বৃষ্টিপাত অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার কারণে চাঁদপুরের পদ্মা, মেঘনা, ধনাগোদা ও ডাকাতিয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হরে। নদীগুলোতে এই অপ্রত্যাশিত পানি বৃদ্ধির ফলে এবছর চাঁদপুরে বন্যার আশঙ্কা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পাশাপাশি পদ্মা-মেঘনার ঘুর্ণি স্রোত বেড়ে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধ। এ অবস্থায় শহর রক্ষা বাঁধ সংরক্ষণে আগে থেকেই সকল প্রস্তুতি নেবার অনুরোধ জানিয়েছেন স্থানীয় সাংসদ ডা. দীপু মনি এমপিসহ চাঁদপুরবাসী।

গত ২১ জুন চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ প্রকল্পের পুনর্বাসনের লক্ষে বিস্তারিত সমীক্ষা শীর্ষক প্রকল্পের কারিগরি এবং পরিবেশগত ও সামাজিক মূল্যায়নের নিমিত্ত মতবিনিময় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী বলেন,চাঁদপুরে বিভীষিকাময় চেহারা নিয়ে বর্ষা আসে। ভাঙন শুরু হলে নদী প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুতিরও সময় দেয় না। আমি জনপ্রতিনিধি হিসেবে বলতে চাই এই মুহুর্তেই শহর রক্ষার কাজ শুরু করতে হবে।

চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুর শহর ভাঙনরোধে ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৪০ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন বাজার এলাকায় ১৭৩০ মিটার শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পরে ২০০৯-২০১০ সালে আরও প্রায় ২৪ কোটি ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে পুরান বাজার এলাকার ১৬৩০ মিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকেই বদলাতে থাকে ভাঙনের চিত্র। চাঁদপুরের মানুষ ফিরে পায় স্বস্তি। কিন্তু বাঁধ নির্মাণের পর দীর্ঘ সময় পার হলেও তা রক্ষায় নেয়া হয়নি কোন স্থায়ী উদ্যোগ।

প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরো জানা যায়, গত ২০১৯ ও ২০২০ সালে চাঁদপুর শহরের পুরানবাজার হরিসভা এলাকায় একাধিকবার ভাঙনের শিকার হয়েছে শহররক্ষা বাঁধ। এতে ৬৭ মিটার এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। বাঁধ রক্ষায় অস্থায়ীভাবে কাজ হয়েছে কয়েক কোটি টাকার। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ সালে ৫৮ মিটার সংস্কার কাজে ব্যয় হয় ২৮ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ সালে ৪৮৫ মিটার সংস্কার কাজে ব্যয় হয় ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং ২০১৯-২০ সালে ৩২৪ মিটার সংস্কার কাজে ব্যয় হয় ১কোটি ১১ লাখ টাকা।

এদিকে বেশ কয়েক বছর আগে চাঁদপুরের মেঘনার পশ্চিম তীরে জেগে ওঠে বিশাল একটি ডুবোচর। অপরিকল্পিত ভাবে বালি উত্তোলনের ফলে জেগে ওঠা এই চরটি স্থানীয়ভাবে মিনি কক্সবাজার নামে পরিচিত। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই চর দর্শনার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অথচ এই চরের কারণে আরো একধাপ হুমকির মুখে পড়ে চাঁদপুর শহররক্ষা বাঁধ। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, শহর রক্ষা বাঁধ টিকিয়ে রাখতে হলে জরুরি ভিত্তিতে পরিকল্পিতভাবে চর খননের পাশাপাশি বাঁধের স্থায়ী সংস্কার প্রয়োজন।

চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক গোপাল চন্দ্র সাহা বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকেই পুরানবাজার ঐতিহ্যবাহী একটি বাজার। বিভিন্ন সময়ে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বাজার অনেকটাই এখন বিলুপ্তির পথে। গত ২০১৯ সাল থেকে ভাঙনে হরিসভা এলাকায় অন্তত শতাধিক মানুষ হারিয়েছেন তাদের বাসস্থান। এভাবে চলতে থাকলে মেঘনায় বিলীন হবে জেলার প্রধান এই বানিজ্যিক এলাকা। তাই ভাঙনরোধে অচিরেই শহররক্ষা বাঁধের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।’

চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রেফাত জামিল জানান, ২০০৯-২০১০ সালের পর বাঁধের স্থায়ী সংস্কার কাজ হয়নি। পরে বাপাউবো গঠিত কারিগরী কমিটির অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ৪২০ কোটি টাকার একটি স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্প তৈরি করে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

গত বছর ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান, আইডব্লিউএমের প্রিন্সিপাল সারওয়াত জাহানসহ বিভিন্ন দপ্তরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়। কমিটি একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনের আলোকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিন হাজার ১০৩ কোটি ২ লাখ টাকার চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ পুনর্বাসন প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। মন্ত্রণালয়ে যাচাই কমিটি চলতি বছরের ৪ মার্চ আবার সম্ভাব্যতা সমীক্ষার মাধ্যমে প্রকল্পের পরিধি এবং কারিগরি বিষয় চূড়ান্ত করার পরামর্শ দেয়। সব কাজ শেষ করে আবারও সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

এদিকে এবারের বর্ষার পানি বৃদ্ধি এবং মেঘনার তীব্র সোতের কারণে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের ভিভিন্ন অংশে ধস দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও দেবে গেছে বালিভর্তি জিও ভ্যাগ এবং সিসি ব্লক। বিশেষ করে বাঁধের পুরানবাজার হরিসভা এলাকার অংশে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।

এ বিষয়ে রেফাত জামিল বলেন, পুরানবাজারে ব্লক দেবে যাওয়ার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানটি চিহ্নিত করে সার্ভে শুরু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে এবং পাশাপাশি ব্লক ডাম্পিংয়ের কাজও চলছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের কাছে ৩ হাজার বালি ভর্তি বস্তা, ১৩ হাজার সিসি ব্লক মজুদ রয়েছে। তবে চাঁদপুরে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদক: আশিক বিন রহিম, ২৩ জুন ২০২২