পারিবারের উদাসীনতার কারণে তরুণ সমাজের অনেকেই আজকাল জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবন ও মাদক পাচারের মতো ভয়াবহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে। বেকারত্ব ও আর্থিক সংকটে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে মাদক কারবারীদের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ফাঁদে পা দিচ্ছে সম্ভাবনাময় এসব তরুণরা। অভিনব কায়দায় পেটেরভেতর করে মাদক পাচার কালে কুমিল্লায় র্যাবের হাতে আটক এমন একদল তরুণের দেয়া তথ্যে বেরিয়ে আসে এমনসব ভয়ানক চিত্র।
১৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার দিবাগত রাতে কারবারীদের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ফাঁদে পা দেয়া ৯ তরুণ শিক্ষার্থীকে কুমিল্লা থেকে র্যাবের হাতে আটক করে র্যাব-১১। তারা পেটের ভেতর করে অভিনব কায়ায় প্রায় ২৪ হাজার পিস ইয়াবা বহন করে নিয়ে আসাছিলো।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কুমিল্লা ক্যাম্পের একটি আভিযানিক দল ১৪ ফেব্রুয়ারি সোমবার দিবাগত রাতে কুমিল্লার কোতয়ালী থানাধীন আমতলী বিশ্বরোড এলাকায় ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে ঐ ৯ শিক্ষার্থীকে একটি বাস থেকে আটক করে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব-১১ সিপিসি-২। পরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে আটক ৯ শিক্ষার্থীরশরীর এক্সরে করলে তাদের প্রত্যেকের পেটে ইয়াবার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পরবর্তীতে চিকিৎসকের পরামর্শে বিশেষ পদ্ধতিতে উক্ত নয় শিক্ষার্থীর পেটের ভিতর থেকে ২৩ হাজার ৯৯০ পিস অক্ষত ইয়াবা এবং ৪০০ পিস ভাঙ্গা ইয়াবা বের করা হয়।
কুমিল্লা র্যাব-১১, সিপিসি-২ এর উপ-পরিচালক কোম্পানী অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন জানান, র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উক্ত ৯ তরুণ জানায় তারা সকলেই শিক্ষার্থী ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়ের শিকার হয়ে তারা এ পথে নেমেছে। গ্রেফতারকৃতদের বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে অন্ধকার এ জগতের অনেক লোমহর্ষক গল্প।
গ্রেফতারকৃত তরুণদের দেয়া তথ্য অনুয়ায়ী ময়মনসিংহের জনৈক এক বড় ভাই মাদক ব্যবসায়ের সাথে জড়িত এবং এই পদ্ধতি অনুসরন করেই সে টেকনাফ থেকে ইয়াবা বহন করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করত। তার গ্রুপের কয়েকজন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গ্রেফতার হয়। পরবর্তীতে সে এলাকার তরুণদের টার্গেট করে এবং প্রথমে আসামী সেলিম কে ম্যানেজ করার পর আসামী সেলিমের মাধ্যমে আসামী রিফাত, গোলাপ, রিশাদ, তোফায়েল ও আশিককে এ কাজে আসতে বাধ্য করে। অপরদিকে জনৈক মাদক ব্যবসায়ীর মহাখালীর বন্ধুর মাধ্যমে প্রথমে আসামী সোহেলকে এবং আসামী সোহেলের মাধ্যমে আসামী মিতুল ও সিয়ামকে মাদক পরিবহনের কাজে সম্পৃক্ত করা হয়। প্রথমে তাদেরকে গাঁজা ও ইয়াবা ফ্রি-তে সরবরাহ করা হয় এবং মাদকের আসরে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে তাদেরকে ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত করে ফেলা হয়। পরবর্তীতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রলোভন এবং উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখানো হয়।
অপরদিকে মাদকাসক্ত হয়ে এই তরুণেরা মাদকের টাকা সংগ্রহ করার জন্য জনৈক মাদক ব্যবসায়ীর দেয়া প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায়। গত জানুয়ারি ২০২১-এ প্রথম পেটের ভিতরে করে ইয়াবা বহন করে সফলভাবে তা ডেলিভারী দিতে সক্ষম হয় তারা। তবে, তাদেরকে প্রাপ্ত টাকা না দিয়ে অর্ধেক টাকা ট্রাক্স হিসেবে রেখে দেয় জনৈক মাদক ব্যবসায়ীরা। তাই এই তরুণরা এই কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে পূর্বের কাজের ধারণকৃত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পুনরায় এই কাজ করতে তাদেরকে বাধ্য করা হয়।
ইয়াবা বহনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে গ্রেফতারকৃত তরুণরা র্যাবকে জানায়- মাদক কারবারীদের নির্দেশে তাদের আব্দুল্লাপুর এর একটি বাস কাউন্টারে যেতে বলা হয়। সেই কাউন্টারে আগে থেকেই উক্ত তরুণদের জন্য কক্সবাজার জেলার টেকনাফগামী বাসের টিকিট কেটে রাখা হয়। বাস টেকনাফ গিয়ে থামলে সেখানে থাকাজনৈক মাদক কারবারী তাদের একটি আবাসিক হোটেলে নিয়ে যায় এবং হোটেলের যে কক্ষে তাদের রাখা হয় সে কক্ষটি সারাদিন বাইরে থেকে তালা মেরে রাখা হয়। সন্ধ্যা নাগাদ জনৈক মাদক কারবারীর ২ থেকে তিনজন লোক হোটেলে এসে ঐ তরুণদের সাথে দেখা করে এবং ইয়াবা পেটে বহন করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
এক্ষেত্রে প্রথমে কলার রস দিয়ে খেজুরের মতো ছোট ছোট পলিথিনে মোড়ানো ইয়াবার পোটলিগুলো পিচ্ছিল করে তারা গিলে ফেলে। এরপর নাইটকোচে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। পথে সার্বক্ষণিক মাদক কারবারীরা তাদেরকে নির্দেশনা দিতে থাকে। মাদক কারবারীদের নির্দেশনা অনুযায়ী ইয়াবাগুলো কখনো নরসিংদী, কখনো আশুলিয়া আবার কখনো মহাখালীতে নির্ধারিত স্পটে মাদক কারবারীদের নিকট পৌছে দিতে হয়। আটককৃতরা র্যাবকে আরো জানায় গত ১ বছরে অসংখ্যবার তারা এ প্রক্রিয়ায় টেকনাফ থেকে ঢাকায় ইয়াবা এনেছে।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ সহ বিভিন্ন এলাকায় এমন আরো কয়েকটি তরুণ শিক্ষার্থীদের গ্রুপ এ পন্থায় মাদক কারবারীদের নির্দেশনায় ইয়াবা আনা নেয়া করে থাকেন। পারিবারিক দৈন্যদশা, বেকারত্ব ও মানসিক অবসাদের কারণে মাদক কারবারীদের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ফাঁদে পা দিতে হয়েছে তাদের বলেও জানায় তারা।
এই প্রক্রিয়ায় ইয়াবা বহন অনে ঝুকীপূর্ণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা: ইশবাল আনোয়ার বলেন, এই প্রক্রিয়ায় ইয়াবা বহন করতে গিয়ে যে কোনো সময় মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। কিন্তু ঝুঁকি জেনেও টাকার লোভে মাদক ব্যবসায়ীদের এমন ফাঁদে পা দিচ্ছে বর্তমান সময়ের অনেক তরুণ।
কুমিল্লা র্যাব-১১, সিপিসি-২ এর উপ-পরিচালক কোম্পানী অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, তরুণ শিক্ষার্থীদের এহেন কর্মকান্ড সম্পর্কে পিতা মাতা অদ্যবধি বিন্দু পরিমাণ কিছু আচ করতে পারেনি। এভাবে অনেক শিক্ষার্থীর উজ্বল ভবিষ্যত অন্ধকারে পতিত হচ্ছে এবং এতে করে জাতি হারাচ্ছে অনেক উজ্বল নক্ষত্র। তাই আমরা সকল অভিভাবককে অনুরোধ করবো আপনারা আপনাদের সন্তানদের সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখুন এবং তাদের চাল চলন ও আচার ব্যবহারে কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে অতিসত্বর কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। এতে করে আপনার সন্তানেরভবিষ্যত যেমন অটুট থাকবে এবং সমাজ তথা দেশ হবে উপকৃত।
গ্রেফতারকৃতরা হলো কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানার চরপাড়াতলা গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে এইচএসসি ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ তোফায়েল আহমেদ (১৯); একই উপজেলার চরপাড়াতলা গ্রামের মাজাহারুল ইসলাম এর ছেলে সদ্য এইচএসসি পাশ মোঃ আশিকুল ইসলাম (১৯); পটুয়াখালী জেলার পটুয়াখালী সদর থানার পশুরবুনিয়া গ্রামের আবুল কালাম আজাদের ছেলে এসএসসিতে অধ্যয়নরত মোঃ সোহেল (২১); নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার পিজাহাতি গ্রামের কামরুল হাসানের ছেলে ডিগ্রী পরীক্ষার্থী মোঃ মিতুল হাসান মাহফুজ (২২); গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানার আমবাগ (কোনাবাড়ী) গ্রামের মৃত মাসুদ ইসলামের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী মোঃ সিয়াম ইসলাম (১৯); ময়মনসিংহ জেলার পাগলা থানার দত্তের বাজার গ্রামের আজিজুল ইসলামের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী মোঃ মিনহাজুল ইসলাম রিফাত (২২); একই থানার বাকশি (পাঠানবাড়ী) গ্রামের ফখরুদ্দিন পাঠানের ছেলে ডিগ্রী পরীক্ষার্থী মোঃ রিশাত পাঠান (২২); একই থানার নয়াবাড়ী গ্রামের মোঃ আসাদ মিয়ার ছেলে ডিগ্রী পরীক্ষার্থী মোঃ গোলাপ (২২) এবং একই থানার বাগশি গ্রামের রতন মিয়ার ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী মোঃ সেলিম (২২)।
উক্ত বিষয়ে গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালি থানায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। মাদকের মতো সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
প্রতিবেদক: জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur