Home / জাতীয় / পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সূচনা হচ্ছে আজ
পারমাণবিক

পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সূচনা হচ্ছে আজ

পাবনা জেলার রূপপুরে পদ্মার পাড়ে চলছে আট হাজারের বেশি দেশি-বিদেশি শ্রমিক-প্রকৌশলীর অবিরাম মহাকর্মযজ্ঞ। মহামারি করোনার মধ্যেও এই কর্মযজ্ঞ চলে পুরোদমে। ইতোমধ্যে দেশের একক বৃহত্তম প্রকল্পটির মূল কাজ প্রায় ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। আজ রোববার কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।

এর ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পথে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে। সংশ্লিষ্টদের আশা, ২০২৩ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎ পাবে বাংলাদেশ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই প্রকল্পে চুল্লি স্থাপনের কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। পাবনার জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন ও ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার পি এম ইমরুল কায়েস বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

চুল্লি স্থাপনের কার্যক্রম উদ্বোধন উপলক্ষে ঈশ্বরদী রূপপুর প্রকল্পে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এজন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ড. ইয়াফেস ওসমান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ড. শৌকত আকবর, রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। এই চুল্লি স্থাপনের মাধ্যমে পরমাণু স্থাপনা নির্মাণের সাফল্য ধারায় নতুন মাইলফলক অতিক্রম করতে যাচ্ছে দেশ। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে যন্ত্রে নিউক্লিয়ার ফুয়েল বা ইউরেনিয়াম থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে তার মূল কাঠামোকে বলা হয় রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লি।

এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাণ হিসেবেই বিবেচনা করা হয় এই বিশেষ যন্ত্রাংশকে। গত বছরের অক্টোবরে রূপপুর কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের জন্য রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেলটি রাশিয়া থেকে জলপথে ১৪ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে দেশে পৌঁছে। ৩৩৩ দশমিক ৬ টন ওজনের পারমাণবিক চুল্লির পাত্রটি স্থাপনের জন্য এক বছর ধরে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অবকাঠামো প্রস্তুত করা হয়। আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুসারে, এটি স্থাপনের জটিল কাজ সম্পন্ন করার মাধ্যমেই গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জিত হবে বলে মত প্রকল্প বাস্তবায়নে থাকা কর্মকর্তাদের।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথম ইউনিটের রিয়্যাক্টর ভবন প্রায় প্রস্তুত। ভৌত অবকাঠামোতে এগিয়ে যাচ্ছে দ্বিতীয় ইউনিটও। এই দুটি ইউনিট থেকে মোট দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। ২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট থেকে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ‘ভিভিইআর-১২০০’ রিঅ্যাক্টর স্থাপিত হবে রূপপুরে। রিঅ্যাক্টরগুলোর কার্যকাল ৬০ বছর, যা প্রয়োজনে আরো ২০ বছর চালানো যাবে। ভিভিইআর টাইপ রিঅ্যাক্টরে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকবে। মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যেমন শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি মোকাবিলায় সক্ষম এই রিঅ্যাক্টর।

প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হলে ৬০ বছর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এর পেছনে বার্ষিক খরচ হবে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা। দেশের ৬ কোটি মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করবে।

রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পরমাণু সংস্থা রোসাটমের কারিগরি তত্ত্বাবধান ও নকশায় এখানে ব্যবহার করা হবে পরমাণু প্রযুক্তির সবশেষ সংস্করণ ভিভিইআর-১২০০ টাইপের দুটি রিঅ্যাক্টর। প্রথম ইউনিটের জন্য চারটি স্টিম জেনারেটর, প্রেসারাইজার, হাইড্রো অ্যাকোমডেটর ও কুল্যান্ট পাম্পের মতো ভারী যন্ত্র এখন রূপপুরের মাটিতে। এই প্ল্যান্ট চালু হলে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে একক উৎস থেকে।

নিউক্লিয়ার পাওয়ার কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. শৌকত আকবর জানান, এ বছরের মধ্যে প্রকল্পের ৫০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করব। পরের ধাপে যন্ত্রাংশগুলো স্থাপন করা হবে। প্রকল্পটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারব বলে আশা করছি।

১৯৬১ সালে পাবনার ঈশ্বরদী থানার রূপপুরে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২-১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনি ইশতেহারে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে। ২০১০ সালে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট হয়। একই বছর জাতীয় সংসদে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি অ্যাক্ট পাস করা হয়। ২০১৩ সালে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর রূপপুরে এক হাজার ৬২ একর জমির ওপরে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে’র প্রথম পর্যায়ের কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ধাপে ধাপে প্রকল্পটি এখন আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা। ঋণ হিসেবে রাশিয়া দিচ্ছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। বাকিটা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প শুধুই একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, এর মাধ্যমে বাঙালি নিউক্লিয়ার জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হবে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেশে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির (ক্লিন এনার্জি) মডেল হিসেবে বিবেচিত হবে, যা থেকে দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যাবে সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও মানসম্মত বিদ্যুৎ। আশা করি, ২০২৩ সালের মধ্যেই প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ওপেন করা যাবে এবং এর পরের বছর দ্বিতীয় ইউনিট চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।