ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের কথিত প্রধান পৃষ্ঠপোষক শেখ সোহেল রানা ভারতে পালাতে গিয়ে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। গতকাল শনিবার ভারতীয় একটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত থেকে সোহেল রানা নামের এক বাংলাদেশিকে আটক করেছে বিএসএফ। তিনিই ই-অরেঞ্জের প্রতারণার ঘটনায় আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা শেখ সোহেল রানা বলে ধারণা করা হলেও দায়িত্বশীল কেউ খবরটি নিশ্চিত করেননি।
ঢাকার বনানী থানায় পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে কর্মরত সোহেল রানা গত দুই দিন কোনো ধরনের ছুটি ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন। তাঁর কোনো হদিস পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা। ই-অরেঞ্জের চেয়ারম্যান সোনিয়া মেহজাবিন জুঁই পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানার আপন বোন। প্রতারণার অভিযোগ উঠলে সোহেল রানারই ঘনিষ্ঠ বীথি আক্তার নামের একজনের কাছে সম্প্রতি লোক-দেখানো মালিকানা বদল করেন সোনিয়া মেহজাবিন। ই-অরেঞ্জের এই কারসাজির পেছনে সোহেল রানার সংশ্লিষ্টতা তুলে ধরে কলের কণ্ঠসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তিনি ছিলেন আইনগত প্রক্রিয়ার বাইরে। এই সুযোগে তিনি পালিয়েছেন বলে দাবি করছেন ভুক্তভোগীরা।
যেখানে সোহেল রানার নাম ই-অরেঞ্জের পরিচালক হিসেবে আছে। প্রতিষ্ঠানটি দুটি ব্যাংক হিসাব থেকে এরই মধ্যে ৩৪৯ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে সোহেল রানা নিজেই আড়াই কোটি টাকা সরিয়েছেন। এই ব্যাংক লেনদেনের প্রমাণও পাওয়া গেছে।
এদিকে গত শুক্রবার ই-অরেঞ্জের ৭৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোহেল রানাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। গত ৩১ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়ার আদালতে ইসতিয়াক হোসেন টিটু নামের এক ভুক্তভোগী একটি মামলার আবেদন করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে গুলশান থানার ওসিকে এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। নথিভুক্ত হওয়া মামলাটির অন্য আসামিরা হলেন মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমান, সিওও আমান উল্লাহ, নাজনিন নাহার বীথি, কাউসার, কামরুল হাসান, আব্দুল কাদের, নূরজাহান ইসলাম সোনিয়া ও রুবেল খান।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. আসাদুজ্জামান গতকাল বিকেলে গণমাধ্যমকে বলেন, সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার অফিস করেছেন সোহেল রানা। পরদিন ছিল শুক্রবার। তবে আজও থানায় আসেননি তিনি। রিপোর্টও দেননি, ছুটিও নেননি। তাঁর ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রের খবর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘খবর পাচ্ছি তিনি নেপাল-ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে আটক হয়েছেন। তবে আমরা এখনো তা নিশ্চিত হতে পারিনি।’
গতকাল ভারতীয় একটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের অভিযোগে শুক্রবার কোচবিহার জেলার চ্যাংরাবান্ধা সীমান্ত থেকে সোহেল রানা নামের এক বাংলাদেশিকে আটক করেছে বিএসএফ। পরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন তিনি।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পরিচালক (অপারেশন্স) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, ‘ভারত-নেপাল সীমান্তে সোহেল রানা নামের এক বাংলাদেশি আটক হয়েছেন বলে শুনেছি, কিন্তু আমরা বিএসএফের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত এ রকম কোনো তথ্য পাইনি।’
গত ১৭ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের এক হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেন প্রতারণার শিকার গ্রাহক মো. তাহেরুল ইসলাম। আসামিরা হলেন ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমান, আমান উল্লাহ, বীথি আক্তার, কাউসার আহমেদসহ সব মালিক। ভুক্তভোগী গ্রাহকরা অভিযোগ করেন, বোন ও ভগ্নিপতি মাসুকুর রহমানসহ ঘনিষ্ঠদের দিয়ে সোহেল রানাই ই-অরেঞ্জ চালাচ্ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মালিকানা বদলের জন্য যে বীথিকে উপস্থাপন করা হয় তিনিও সোহেলের ঘনিষ্ঠ। একসময় গুলশানের কোরিয়ান ক্লাবে চাকরি করতেন বীথি। সেখানে যাতায়াতের সূত্র ধরেই সোহেল রানার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। বীথিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে একাধিক সংস্থা। বোন-ভগ্নিপতি গ্রেপ্তারের পর অভিযোগ অস্বীকার করে বহাল তবিয়তে চাকরি করছিলেন সোহেল।
নথিপত্র সূত্রে জানা গেছে, ই-অরেঞ্জের মূল কম্পানি ‘অরেঞ্জ বাংলাদেশ’ নামের প্রতিষ্ঠান খুলতে যে টিআইএন সনদ নেওয়া হয়, সেখানে পরিচালক হিসেবে সোহেল রানার নাম আছে। গুলশানের একটি ঠিকানা থেকেই অরেঞ্জ বাংলাদেশ ও ই-অরেঞ্জ পরিচালনা করা হয়। অরেঞ্জ বাংলাদেশের ই-টিনে অথরাইজড পারসন হিসেবে আছেন নাজমা সুলতানা পিয়া। তিনি সোহেল রানার সাবেক স্ত্রী। সূত্র আরো জানায়, লন্ডনে পড়তে গিয়ে ডলপিউ নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় সোহেলের। তাঁর হাত ধরে ই-অরেঞ্জের পথচলা। কিছু দিন লন্ডনে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ছিল। পরে বাংলাদেশে তাঁরা কার্যক্রম শুরু করেন। পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা গত বছরের নভেম্বর থেকে ছয় মাসে একটি ব্যাংক হিসাব থেকে তুলেছেন দুই কোটি ৪৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা। মোট ৩৪৯ কোটি টাকা তোলা হয়। বাকি টাকা তুলেছেন তাঁরই স্বজন ও ঘনিষ্ঠরা।
ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমান ও চিফ অপারেটিং অফিসার আমান উল্লাহ চৌধুরীসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। বীথি আক্তার ও কাউসার আহমেদ নামের দুই আসামি এখনো পলাতক। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম বলেন, পরিদর্শক সোহেলের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়। তাঁর দাবি, বোনের অনুরোধে ই-অরেঞ্জের হিসাব থেকে টাকা তুলে দিয়েছেন তিনি
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur