চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক :ইয়াসমিন। ২০০৫ সালে মা-বাবার সঙ্গে লঞ্চে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় ফিরছিল। লঞ্চে উঠে এপাশ থেকে ওপাশ হাটছিল সে। এক সময় বাদাম খেতে খেতে লঞ্চের ছাদে উঠে পড়ে। ঠিক তখনই শুরু হলো প্রচণ্ড বাতাস। এতে মাঝ নদীতেই উল্টে গেল লঞ্চটি। এরপর জ্ঞান ফিরে সে দেখতে পেল তার চারপাশে শুধু লাশ আর লাশ। এক পর্যায়ে লাশের ওই সাঁরিতে সে তার বাবা-মায়ের লাশ খুঁজে পেল। এরপর সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ঠিক তখন থেকেই সে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। এরপর থেকেই ইয়াসমিন ঠিকানাবিহীন।
ইয়াসমিনকে ওই বছরই ঢাকার মোহাম্মদপুরের রাস্তা থেকে মো. সাহেদ নামে এক অটোরিকশাচালক তুলে নিয়ে আসে তার বাড়িতে। তখন ইয়াসমিন শুধু তার নাম ও একটি লঞ্চ দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছিল না, এমনকি তার মা-বাবার নামও। এরপর স্কুলে ভর্তি করানো হয় তাকে। দেখতে দেখতে ইয়াসমিন পটিয়া এজে চৌধুরী স্কুলের সপ্তম শ্রেণির পাট চুকিয়ে ফেলে। যখন সে হারিয়ে যায় তখন সে ৩য় শ্রেণিতে পড়তো। এরপর ইয়াসমিনের জীবনের গল্পে বড় মোচড় নিয়ে আসে আরেকটি দুর্ঘটনা।
সাহেদ জানায়, একদিন স্কুল থেকে ফিরে কী কারণে যেন পুকুরের দিকে গিয়েছিল ইয়াসমিন। হঠাৎ সে দেখতে পায়, দুই বছরের এক শিশু পানিতে ডুবে যাচ্ছে। এরপর সে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উদ্ধার করে পাড়ে তোলে শিশুটিকে। তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ইয়াসমিন। জ্ঞান ফেরার পর সে হয়ে ওঠে অন্য এক ইয়াসমিন। এত দিন হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারেনি যে স্মৃতি, অথচ সবকিছু জাদুমন্ত্রের মতো একের পর এক মনে পড়ে যেতে থাকে তার। তার মনে পড়ে যায় ফেলে আসা জীবনের মা-বাবা, বাড়ি, শৈশবের সহপাঠী, স্কুলের নাম—আরও অনেক কিছু।
ইয়াসমিন জানায়, সম্ভবত ২০০৫ সাল। এপ্রিলে আমার জন্মদিন ছিল। সম্ভবত সেদিন ছিল ৭ তারিখ। আমরা চাঁদপুরে জন্মদিন পালন করে ঢাকায় ফিরছিলাম। ফেরার পথে লঞ্চ দুর্ঘটনাটি ঘটে। আমার পাপ্পির (বাবা) নাম রাকিবুল হাসনাত। মাম্মি (মা) রিয়া মুন্নী। পেশায় ডাক্তার। আমাদের বাড়ি চাঁদপুরে, দাদার নাম সাব্বির জাফর। আমার বাবা দাদুর একমাত্র ছেলে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সিলেট-টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যাওয়ার কথাও মনে পড়ছে একটু-আধটু। স্মৃতি ফিরে পাওয়া ইয়াসমিন গড়গড় করে বলতে থাকে আনুমানিক ছয় বছর আগে তার ফেলে আসা জীবনের কথা। চাঁদপুরে ও ঢাকায় আমাদের দুটো বাড়ি। ঢাকার বাড়িটি মাতুব্বর বাজারের কাছে। ঢাকার কাছাকাছি একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তাম। স্কুলের নাম ম্যাক্সাসাইট। পুরো নাম মনে নেই। নানা বাড়িতে কখনো যাইনি। আমার মাম্মি (মা) নানাবাড়ির কথা কখনো মুখে আনত না। আনতে নিষেধ করত। নানার নামও জানি না। আমাদের ঢাকার বাসায় এক আন্টি ছিলেন। তিনি বাসার কাজ করতেন। মা-বাবা তাকে আন্টি ডাকতে বলে দিয়েছিল। আমাদের গাড়িচালকের নাম জিয়া। যে ইয়াসমিন এতদিন বাবা-মায়ের নাম বলতে পারতো না, সে এখন তার শৈশবের সহপাঠীর নামও বলতে পারছে। আমার বন্ধু ছিল কিরণ। সুমন আঙ্কেলের ছেলে। ঢাকায় তাদের বাড়ির সামনে একটি বাঘ ছিল। সেটি দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখাত। আমি তার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলতাম।
সে জানায়, দুর্ঘটনার পর এক পুলিশ আঙ্কেল আমার গলার লকেটে মাম্মি-পাপ্পির (মা-বাবার) ছবি দেখে কয়েকটা লাশ দেখালেন। সেখানে বাবা-মায়ের লাশ ছিল। তারপর উনি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। দুই-তিন দিন তার কাছে রাখলেন। এরপর উনি বললেন, এখানে চোর-ডাকাত বেশি। তোমার লকেট, নূপুর আমার কাছে রাখো। একদিন পুলিশ আঙ্কেল গাড়ি করে আমাকে বাইরে নিয়ে গেলেন। তারপর রাস্তায় আমাকে একটি চিপস কিনে দিয়ে মোবাইলে কথা বলতে বলতে চলে গেলেন। আর ফিরলেন না। এরপর আমি আর কিছুই জানি না।
পাঠক এতক্ষণ যে মেয়েটির বর্ণনা দিলাম ওই ঘটনাটি বাংলাদেশের এক সময়ের আলোচিত ঘটনা। জানিনা আজো ইয়াসমিন তার স্মৃতিশক্তি ফিরে পেয়েছে কি না। খোঁজ পেয়েছে কিনা তার দাদা দাদীর। ছয়টি বছর যে অটোরিকশা চালক তাকে লালন পালন করে বড় করেছে সেই সাহেদের কোনো খোঁজ জানিনা আমি। এখন কোথায় আছে ইয়াসমিন, কার সঙ্গে আছে খুব জানার ইচ্ছে করছে।
যে সময়টিতে ইয়াসমিনের জীবনে এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল ওই সময় সামাজিক গণমাধ্যমের এত জনপ্রিয়তা ছিল না। থাকলে হয়তো ইয়াসমিন আজ বাজরাঙ্গি ভাইজান সিনেমার মুন্নীতে (সাহিদা) পরিণত হতো। কেউবা হয়ে উঠতো ওই সিনেমার সালমান খান চরিত্রের বাজরাঙ্গি।
২০১২ সালে সর্বশেষ ইয়াসমিনকে শ্যামলীতে মানসিক ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখা গেছে। এরপর আর কিছুই জানিনা। ইয়াসমিন যেখানেই আছো, সেখানে অনেক ভালো থাকো আপু।
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur