চাঁদপুরে প্রকৃত হিজড়াদের পাশাপাশি স্বেচ্ছায় হিজরা হওয়া ছেলেদের সংখ্যা আসংখ্যাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন ওষুধ সেবনের মাধ্যমে হরমোনের পরিবর্তন ঘটিয়ে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদেরকে হিজড়ায় রূপান্তর করছে তারা।
চাঁদপুর শহরে বিভিন্ন স্থানে এমন অসংখ্য ছেলের দেখা মিলছে হরহামেশা। তবে নারী-পুরুষ মাঝামাঝি পোশাক ও সাজুগুজু করে থাকলেও তাদের প্রকৃত হিজড়াদের মতো মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলতে দেখা যায় না। এর মূলত বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে নাচ করে থাকে। কখনো কখনো সামাজিক আচার-আয়োজনেও তাদের দেখা মিলছে। চাঁদপুরে এমন হিজড়া তরুণের নংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ জন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, হিজড়া সাধারণত তিনরকম। ১- প্রকৃত হিজড়া (True Hermaphrodite), ২- অপ্রকৃত পুরুষ হিজড়া (Male Pseudo Hermaphrodite), এবং ৩- অপ্রকৃত নারী হিজড়া (Female Pseudo Hermaphrodite)। আমাদের দেশে মেয়ে হিজরা ও ছেলে হিজড়ার সংখ্যাই বেশি। মেয়ে হিজড়াদের জেনেটিক সেক্স ডাবল এক্স। এদের আভ্যন্তরীণ সেক্স মেয়েদের মতো, অর্থাৎ দেহের ভেতরে ডিম্বানু তৈরিকারী অঙ্গ (অভারী) থাকে কিন্তু বাইরের সেক্স পুরুষের মতো বা দ্বৈত হতে পারে। অপরদিকে ছেলে হিজড়াদের জেনেটিক সেক্স এক্স ওয়াই।
এদের আভ্যন্তরীণ সেক্স ছেলেদের মতো অর্থাৎ দেহের ভেতরে শুক্রানু তৈরিকারী অঙ্গ (টেসটিস) থাকে কিন্তু বাইরে সেক্স মেয়েদের মতো বা দ্বৈত হতে পারে।
জানা যায়, এ উপমহাদেশে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত হিজরা সম্প্রদায়। বাংলাদেশে যারা সরকার কর্তৃক আইনগতভাবে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত। দুঃখজনকভাবে সত্য হলো, বর্তমান সমাজব্যবস্থায় হিজড়া সম্প্রদায়ের কোনো স্থান নেই। সুযোগ নেই সম্মানজনক পেশা গ্রহণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবন যাপনের। ফলে জীবন ধারণের তাগিদেই তাদের বেছে নিতে হচ্ছে বিতর্কিত কাজ। তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াদেরকে দেখলে ‘ভয় কিংবা লজ্জা’ পান অনেকেই।
কারণ জীবিকার প্রয়োজনে তাদের অনেকেই টাকার জন্য মানুষকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেন। তবে দিনশেষ হিজড়া সম্প্রদায় মানবেতর জীবন-যাপন করে থাকে। চাঁদপুরেও যার ব্যত্যয় ঘটেনি। এসব জেনেও উঠতি বয়সের তরুণরা কেন স্বেচ্ছায় হিজড়া খাতায় নাম লিখছেন, তা নিয়ে সচেতন মহল উৎবেগ প্রকাশ করছে।
করোনার কঠোর লকডাউন চলাকালীন গত ৫ জুন সোমবার চাঁদপুর স্টেডিয়ামে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শতাধিক হিজড়াদের প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়। ওই সময় কুয়াশা হিজড়া গ্রুপে থাকা পাঁচ-ছয়জন হিজড়া ছেলের আচরণ সন্দেহজনক মনে হয়। তাদের সম্পর্কে অন্য গ্রুপের হিজড়াদের সঙ্গে কথা বলে মেলে ভয়ংকর তথ্য। ছেলে হিজড়া গ্রুপে থাকা অনেক ছেলেই ইচ্ছাকৃতভাবে হিজড়া হয়েছেন। এ ছাড়া তারা শরীরে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করে ও আচরণ-ভঙ্গি পাল্টিয়ে অনেকে হিজড়া হচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদপুরের ছেলে হিজড়াদের গ্রুপের নাম ‘কুয়াশা’। এ গ্রুপের দলনেতা হলেন শাওন ওরফে তানিয়া। শাওন চাঁদপুর শহরের ছেলে। তিনি শহরের ডিএন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। এক সময় চাঁদপুরের জনপ্রিয় একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের নৃত্য প্রশিক্ষক ছিলো সে। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মধ্যে পরিবর্তন শুরু হয়। কয়েকমাস পর শাওন হিজড়ায় রূপান্তরিত হন। এখন সেই শাওন চাঁদপুরের ছেলে হিজড়াদের দলনেতা। শুধু শাওনই নয়, তার মতো অনেক ছেলেই ইচ্ছে করে নাম লিখিয়েছেন হিজড়াদের খাতায়।
এ বিষয়ে হিজড়া দলের নেতা শাওন বলেন, ‘আমাদের গ্রুপে আগে ৭-৮ জন ছেলে হিজড়া ছিল। এখন প্রায় ৭০ জনের মতো রয়েছে।’ তবে তার দলের অনেকেই ছেলে হয়েও কেন ইচ্ছাকৃত হিজড়া হয়ে যাচ্ছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বেশি কিছু বলা যাবে না।’
ছেলে হিজড়া গ্রুপের আরেক সদস্য মাইনুদ্দিনকে (২৪) সন্দেহজনক হিজড়াদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি কোনো কথা বলেননি। এ সময় অন্য হিজড়াদের নিয়ে পালিয়ে যান মাইনুদ্দিন।
এদিকে, মৌসুমি হিজড়া গ্রুপের সদস্য কারিনা (৩০) বলেন, ‘আমাদের হিজড়া গ্রুপে দুইশর মতো হিজড়া রয়েছেন। সরকার যদি প্রকৃত হিজড়াদের থাকার এবং কাজ করার ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে আর মানুষকে হয়রানি করতাম না। আমরাও চাই আমাদেরকে সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হোক। যাতে করে আমরাও অন্যদের মত সমাজে বসবাস করতে পারি।’
ছেলে হিজড়াদের সম্পর্কে কারিনা বলেন, ‘অনেক ছেলে বিভিন্ন ওষুধ খেয়ে মেয়েদের মতো শরীর বানায়। তারা মেয়েদের জামাও পরে। কিন্তু তাদের কাজের সঙ্গে আমাদের মিল নেই।’
এ বিষয়ে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের চাঁদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন্নবী মাসুম বলেন, ‘ওষুধের মাধ্যমে কোনো ছেলে হিজড়া হওয়ার সুযোগ নেই। তবে তারা বিভিন্ন ওষুধের মাধ্যমে হরমোনের পরিবর্তন ঘটিয়ে হয়তো মেয়েলি ভাব তৈরি করতে পারে। ওই সব ছেলে হয়তো মেয়েলি ভাব-ভঙ্গি আয়ত্ত করে নিজেদেরকে হিজড়া হিসেবে উপস্থাপন করছে।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ইউএনডিপির মাধ্যমে তাদের থাকা-খাওয়া এবং কর্মস্থানের একটি ব্যবস্থা হচ্ছে।
প্রতিবেদক: আশিক বিন রহিম, ৯ জুলাই ২০২১