কবি পতী প্রমীলা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হন ১৯৩৯ সালে। কবি পত্মী প্রমীলার এ অসুস্থতায় কাজী নজরুলের জীবনেও নেমে আসে চরম দুর্দশা ও দুর্গতি। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের স্বত্ব,গ্রামফোন রেকর্ডের রয়্যালিটি হস্তান্তরের মাধ্যমে কবি প্রমীলার চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন কবি। কিন্তু প্রমীলা নজরুল আর সুস্থ হননি।
১৯৪১ সালে কবি নজরুল তখন দৈনিক নবযুগের প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন তৎকালীন সু-সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ। এ বছরের ৫ এপ্রিল কবি কলকাতার মুসলিম ইন্সিটিটিউটে বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির সভায় একটি ভাষণ দেন-সেটাই তাঁর জীবনের শেষ ভাষণ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে ।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতার অলইন্ডিয়া রেডিতে শিশুদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করার সময় ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই তিনি অসুস্থ হঠাৎ হয়ে পড়েন্। কবির পাশে তখন ছিলেন কবির অত্যন্ত কাছের বন্ধু নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়।
এ সময় কবির পক্ষাখাতগ্রস্ত সহধর্মিণী প্রমীলা,কবি নিজেও অসুস্থ ও দু’পুত্র সব্যসাচি ও অনিরুদ্ধ কেবলমাত্র ১১-১২ বছর বয়সের। এতোদিন পর্যন্ত কবির শ্বাশুড়ি গিরিবালা দেবিও তাদের সাথেই ছিলেন।‘নাতিদ্বয়,মেয়ে ও জামাই’কে গিরিবালা ছাড়া তখন আর দেখার কেউ ছিল না।
কবি নজরুল ইসলাম অসুস্থ হওয়ার পরপরই প্রথমে যে ডাক্তার তাঁকে চিকিৎসা করেন তার নাম হলো ডা. ডিএল সরকার । তিনি তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসা করেন ।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৪২ সালে মধুপুরে ডা.সরকার নামে একজন চিকিৎসক কবিকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করেন। এর পরে তাঁর একজন বন্ধুপ্রতিম কবিরাজ বিমলাানন্দ তর্কতীর্থ কবিরাজি ব্যবস্থায় চিকিৎসা করেন। ১৯৪২ এর আগস্টে বাকশক্তি হারানোর অজ্ঞাত কারণ বুঝতে পেরে তাঁকে মধুপুরে তাঁর চিকিৎসা করা হয়। এ সালে কলকাতায় সাহিত্যিগণ গঠন করেন নজরুল নিরাময় সমিতি। কাজী আবদুল ওয়াদুদ ছিলেন এ সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
কয়েক সপ্তাহ পরও চিকিৎসার কোনো উন্নতি হয়নি। এ সময় কবির মানসিক ভারসাম্য আরও অবনতি ঘটলে অক্টোবর মাসে তাকে লুম্বিনি পার্ক মানসিক হাসপাতালে আনা হয়। ডা.নগেন্দ্রনাথ দে ও ডা.গিরিন্দ্র শেকর বসুর চিকিৎসাধীনে ভর্তি করা হয়। সেখানেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় ১৯৪৩ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে কলকাতার বাসায় ফিরে আনা হয়।
কলকাতায় তিনি সাহিত্য সমিতি গঠনের মাধ্যমে কবিকে বিদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এ সময় কবিকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপের কোনো এক দেশে পাঠানোর কথা থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্যে তা সম্ভব হয়নি।
১৯৪৬ সালে নানা কারণে গিরিবালা নিরুদ্দেশ হয়ে যান্। কবি নজরুল অসুস্থ হওয়ার পর দু:খের দিনগুলোতে সবচেয়ে কাছে ছিলেন যিনি নিজের পরিবার, চাকরি, ব্যবসা , ব্যক্তিগত সবকিছ’ ভুলে ও দু:খ,আনন্দ ,বেদনা , উল্লাস ও বিনোদন পরিহার করে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি হলেন একমাত্র ব্যক্তি জুলফিকার হায়দার।
এরপর এ সমিতির উদ্যোগেই কবি ও কবির পত্মী প্রমীলা দু’জনকেই ১৯৫২ সালের ২৫ জুলাই পর রাচীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভতিৃ করানো হয়। ৪ মাস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও কবির রোগ নির্নয় করা যায়নি। অত:পর ১৯৫৩ সালের মে মাসে তাদের দু’জনকেই বিদেশে পাঠানোর জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ করে ঐ সমিতি । একটি মেডিকেল বোডর্ও গঠন করা হয়।
১৯৫৩ সালের ১০ মে কবি ও কবিপতীœ প্রমীলা,অনিরুদ্ধসহ জনৈক রকিবউদ্দিন আহমেকে সমুদ্রপথে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয় এবং ৮ জুন তাঁরা লন্ডনে পৌঁছেন।
সেখানকার বিখ্যাত ৩ জন চিকিৎসক মিলে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। এঁরা হলেনÑবিখ্যাত চিকিৎসক রাসেল ব্রেইন, ডা.উইলিয়াম সারগ্যান্ট ও ডা.ম্যাককিংকা। সেখানে তারা রোগ নির্ণয়ে বলেন,‘মস্তিস্কে প্যারালেটিক অ্যাটাকের কথা উল্লেখ করেন এবং মন্তব্যে লিখেন ‘কবির মস্তিস্কজনিত রোগটি দুরারোগ্য।’
১৯৫৩ সালের ৭ ডিসেম্বর কবিকে ভিয়েনায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিশিষ্ঠ ¯œায়ূচিকিৎসক ডা. হানস হফ এর চিকিৎসাধীন রাখা হয়। ৯ ডিসেম্বর কবির সেরিব্রাল অ্যানজিগ্রাফি নামে একটি এক্সরেও করানো হয়। এ রিপোর্টে লেখা হয় ‘কবি পিকস ডিজেজ’ নামক মস্তিস্ক রোগে ভুগছেন’ এবং নিরাময়ের কোনোই আশা নেই বলে জানান।
এরপর কবির ঔ চিকিৎসার রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জার্মানী ও সোভিয়েত রাশিয়ায় পাঠানো হয় । চিকিৎকগণ রিপোর্ট লিখেন , ‘কবির বর্তমান অবস্থা থেকে সুস্থ হওয়া অসম্ভব।’
এরপর ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর কবিকে রোম থেকে বিমানে করে ফিরিয়ে আনা হয় ভারতে। ফলে কবি নীরব নিথরতার মধ্যেই চিকিৎসার জন্যে এভাবেই জীবন অতিবাহিত করেন ১৯৪২ থেকে ১৯৫৩ প্রায় ১১ বছর । ১৯৬২ সালের ৩০ জুন মাসে ৪৫ বছর বয়সে কবিপত্মী প্রমীলা নজরুল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। এরপর কবি’র পাশে আপন বলতে কেউ আর ছিল বলে মনে হয় না।
প্রমীলা ইসলাম ধর্মগ্রহণ না করলেও প্রমীলার ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে কবির গ্রামের বাড়ি বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় কবির পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
১৯৪২ থেকে ১৯৫৩ সালে পর্যন্ত যারা করিব সুখ-দুঃখের সহমর্মী হয়ে চিকিৎসার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেন তাঁরা হলেন তৎকালীন মন্ত্রী ড.শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, রজনীকান্ত দাস, জুলফিকার হায়য়দার,স্যার এফ.রহমান,তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়,হুমায়ুূন কবীর , সত্যেন্দ্র নাথ মজুমদার ও তুষার কান্তি ঘোষ প্রমুখ ।
১৯৬০ সালে ভারত সরকার কবিকে ‘পদ্মভূষণ’রাষ্ট্রীয় উপাধি দেন। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কবি ভারতের কলিকাতাই ছিলেন।
তথ্যসূত্র :মো.হাবিবুর রহমান রচিত‘ছোটদের নজরুল,নবারূণ ও বাংলাদেশ সচিত্র মাসিক প্রত্রিকা, শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত-‘নজরুল জীবনের ট্য্রাজেডি’,ডা.আনিস আহমেদের সম্পাদনায় ‘কাজী নজরুলের জীবনী’এবং ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত ছবি) (১২তম পর্ব শেষ- চলবে আরও ক’টি পর্ব )
লেখক: আবদুল গনি, সাবেক শিক্ষক,সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক,নজরুল গবেষণা পরিষদ,চাঁদপুর। ২৭ জুন ২০২১ ।