Home / শিল্প-সাহিত্য / মন পড়ে রয়
story-...

মন পড়ে রয়

দীপন ও শীপন আজ খুব খুশি। মা বলেছে ওদেরকে নিয়ে পরশু নানা-বাড়ি যাবে। তাই ওদের আনন্দ আর ধরে না। কখন যাবে,কি করবে,মামাতো ভাইবোনদের সাথে খেলা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে ওরা অস্থির হয়ে পড়ে। ফুটবল, ক্রিকেট বল, কেডস, স্যান্ডেল, জামাকাপড়, মায়ের চোখ বাঁচিয়ে নিজেদের জমানো টাকায় কেনা বেশ কিছু ক্যান্ডি চকোলেট ব্যাগে পুরে নেয়।

ওরা থাকে রাজধানীতে বনেদী এলাকায় ইট পাথরের জমানো প্রাসাদে। যেখানে প্রাণ বৈচিত্র বলতে ওরা দুভাই, বাবা-মা,একজন ছুটা বুয়া, ড্রাইভার, দারোয়ান, মালি,একটি বিড়াল,খাঁচায় পুরে রাখা কয়েকটি পাখি,বাইরে ঘেউ ঘেউ করা তিনটি সারমেয়,বাগানে ফুল গাছের পাশ দিয়ে ছুটে চলা ছোট্ট পিপড়ের সারি,সীমানা-প্রাচীরের কোল ঘেষে স্তুপীকৃত মাটির নিচে অবস্থান নেয়া দুটি ইঁদুর। অবশ্য ওদের একটি মাত্র বোন রয়েছে। যে কি না বিয়ে করে স্বামীর সাথে ইউরোপের উত্তর দিকে অবস্থিত হাজারো হ্রদের দেশে সুখে শান্তিতে বাস করছে।

প্রযুক্তির কল্যাণে হাজার মাইল দূরে অবস্থানরত ওদের একমাত্র বোন নায়লার সাথে নিয়মিত ভিডিও কলে কথা হয়। আহ্ কি সুন্দর ছিমছাম সাজানো বিদেশ,কবে ওরা যেতে পারবে সে চিন্তা ওদের মনে সবসময়। মা ওদের দুভাইকে বিদেশ যেতে দিতে চায় না, পাছে যদি দেশে না ফিরে সে ভয়ে।

বাবা-মায়ের অতি আদরের হওয়ায় হয়তো ওদের জীবন বৈচিত্র্যময় নয়। এমনিতেই চারদেয়ালে বন্দি জীবন,বাইরের জগৎ বলতে স্কুলে বন্ধুদের সাথে পড়ালেখা, মাঝে মাঝে মায়ের সাথে পার্কে ঘুরতে যাওয়া। বাবা বড় ব্যবসায়ী, তাঁকে তো পাওয়াই দায়। জামাল সাহেব দুদিনের জন্য শ্বশুর-বাড়িতে যাবেন, ছেলেরা তাতেই বেজায় খুঁশি যেন ঈদের চাঁদ দেখা অথবা মায়ের মুখে শুনতে পাওয়া প্রিয় কথা আর পড়তে হবে না বাবা।

গাড়িচালক আফজাল মিয়া পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই শ্মশ্রুমন্ডিত,দক্ষ, বিশ্বস্ত। আফজাল মিয়া যুবক বয়সে জামাল সাহেবের গাড়ির ড্রাইভিং শুরু করে এখন চুল দাড়ি পাকিয়েছে। ভালো আচরণ আর গাড়ি চালানোর দক্ষতা তাকে এক ভিন্ন মর্যাদা এনে দিয়েছে। অবশ্য জামাল সাহেবের পরিবারের সবাই তার প্রতি সদয়। এ বাড়ির বাজারের দায়িত্বটাও সামলাতে হয়। কখনও দু’টাকা মেরে দেয়ার চিন্তা সে করেনি। রেয়ার ভিউ মিররে মনিবের সুন্দরী স্ত্রীকে দেখার চেষ্টা সে করেনি। ধীরে ধীরে সে এ পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছে।

প্রা্ইভেট গাড়িযোগে সকাল সকাল ওরা রওনা করে । ঢাকা থেকে গ্রামে নানাবাড়ি পৌছতে প্রায় চার ঘন্টার কিছু বেশি সময় লাগে। পরিবারের গিন্নি রোখসানা বেগম যাত্রাপথে সবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে নুডলস ও স্যান্ডউইচ বানিয়ে এনেছেন। তাঁর রান্নার হাতও চমৎকার। কয়েক প্রকারের সবজির সাথে ছোট ছোট চিংড়ি এবং মুরগীর মাংসের কুচি দিয়ে নুডলস করেছেন যা বাচ্চাদের তো বটে জামাল সাহেবেরও খুব পছন্দের।

শহর ছেড়ে বেরোতেই রাস্তার পাশে এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা ময়লার ভাগাড়। পলেস্তারা খসে যাওয়া পুরনো দেয়ালের মত দেখতে কয়েকটি নেড়ি, আকাশে চক্কর দেয়া চিল আর অসংখ্য কাক জায়গাটিকে ঘিরে রেখেছে। তারই মাঝে নগ্ন পায়ে প্লাস্টিকের লম্বা ঝোলা কাধে এল-ডোরাডোর সন্ধানে কয়েকজন টোকাই। শীপন ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করে টোকাইদের পায়ে জুতা নেই কেন? কোন জবাব দেয় না জামাল সাহেব।

অতীতের কথা স্মরণ করে আটকে থাকা নিঃশ্বাস সন্তর্পনে ছেড়ে দেন। জামাল সাহেবের বাল্যকালটা সহজ ছিল না। সে সব পুরনো দিনের কথা তিনি আর মনে করতে চান না। টোকাইদের স্থানে নিজের দু সন্তানকে চিন্তা করে রোখসানা বেগমের ভিতরটা গুমরে উঠে, অজান্তে দুফোটা অশ্রু কপোলে নেমে আসে।

শহর ছেড়ে বড় রাস্তায় পড়তেই ভারী বাতাসটা হালকা হয়ে আসে। রাস্তার দুধারে বড় বড় গাছ পাতলা হলেও ডালপালা মেলেছে বেশ। যানবাহনের ছেড়ে দেয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড গিলে গাছগুলো বেশ পুষ্ট, অবশ্য মাত্রাতিরিক্ত ধূলিকনায় পাতাগুলো বিবর্ণ। দুধারে সার বেধে দাড়িয়ে আছে রেইনট্রি, আকাশমনি ও শিশুকাঠ। কিছু শিমুল, বট ও পাকুড়ের দেখা মেলে। কে যেন যত্ন করে সার বেধে তাল এবং অর্জুন গাছ লাগিয়েছে। বেচারা অর্জুন গাছগুলোর পিঠের চামড়া বড্ড নির্মমতায় তুলে নিয়েছে মানবসন্তান। হয়তো হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের ভাতে মারবে এ আক্রোশে। বোবা গাছগুলোর কান্না কি কেউ শুনতে পায়?

সাই সাই করে গাড়ী ছুটছে। রাস্তার দুধারের দৃশ্যগুলো দ্রুত পিছনে সরে যাচ্ছে। দুপাশে সবুজ ফসলের ক্ষেত। সরিষা, কলাই, মটরশুটি, পেয়াজ, রসুন, গাজর, নানান রকমের সবজি আর বিস্তৃত ধানক্ষেত। চোখ জুড়িয়ে যায় শ্যামল বাংলার সিগ্ধতায়। জামাল সাহেব গুনগুন করে গেয়ে ওঠে এমন দেশটি কোথাও খুজে পাবে নাকো তুমি, সুর মেলায় স্ত্রী সন্তানেরাও।

শহর ছেড়ে অনেকটা দূরে এখন ওরা। রাস্তার দুপাশের গাছগুলি অনেকটা ঘন হয়ে এসেছে। কোথাও কোথাও ডালপালা মেলে চাদোয়া তৈরি করেছে। নিচে দু দিকেই গাঢ় সবুজ ঝোপঝাড় যেন সবুজের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। যেন আসমান হতে সবুজ রং ঢেলে দেয়া হয়েছে। রাস্তার পাশে ছোট্ট ডোবা সেঁচে মাছ ধরছে কয়েকটা ন্যাংটু পুটু। শীপনের হাসি দেখে অন্যরাও হেসে ফেলে। এক জায়গায় ওরা দেখতে পায় গাছের ডাল পুতে স্ট্যাম্প বানিয়ে ক্রিকেট খেলছে গাঁয়ের ছেলেরা।

ঘরের দাওয়ায় বসে মহিলাদের উকুন বাছা,ক্ষেতে কিষাণের কাজ, মধ্যবয়সী এক ব্যাক্তির মাঠে গরু চরানো, এক ঝাক রাজহাঁস, পানকৌড়িঁ আর বকের সহবস্থান, যা দেখে তাই ভালো লাগে, অসম্ভব ভালো। অনেকক্ষন ধরে হিসু চেপে রেখেছে শীপন। আর পারেনা, মায়ের দিকে তাকিয়ে ডান হাতের কড়ে আঙ্গুল তুলে দেয় সে। দীপনও যেন সেটাই চাইছিল।

এখানে মহাসড়কে পেট্রোল-পাম্প অনেকটা দূরে। তাই বাধ্য হয়েই রাস্তার পাশে গাড়ী দাড় করাতে হয়। রাস্তার ঢাল বেয়ে কিছুটা নেমে দুভাই পৃথক যায়গায় দাড়ায়। অসংখ্য বুঁনো ফুলে ছেয়ে অছে জায়গাটি। ছোট ছোট ঝোপ। তারই মাথায় ঝাকড়া চুলের মত ছেয়ে আছে সোমলতা। বারে বারে পিছনে ফিরে দেখতে দেখতে ছুটে যায় একটি নকুল। একটু ভয় পেয়ে যায় শীপন।

ঝোপের মধ্যে সদা ত্রস্ত-ব্যস্ত টুনটুনি। শীপন ভাবে মাকে জিজ্ঞেস করবে মিনিটে কতবার ডানা নাড়ায় টুনটুনি। লম্বা লেজ উচিয়ে এ ডাল হতে ওডালে লাফিয়ে চলে কাঠবিড়ালী। ভাইয়া দেখ দেখ কাঠবিড়ালী, বলতেই দীপন ব্যস্ত হয়ে ভিজিয়ে দেয় নিজের প্যান্টের কিছুটা।

কাঠবিড়ালী কাঠবিড়ালী সে কি উচ্ছ্বাস দুজনের। ফুলের উপর ছুটে চলা কালো ভ্রমর, হলুদ রঙ্গের দেখতে কয়েকটি ভীমরুল, একঝাঁক ফিনফিনে পাখার ফড়িং,কয়েকটি দারুন সব রংয়ের প্রজাপতি, নাম না জানা পাখির কিচির মিচির, মাটিতে ধীরে অতি ধীরে বয়ে চলা লাল রংয়ের একটি শতপদী কেন্নো,চিকন পাতার ছোপ ছোপ ঘাস, দূর্বা, বিষকাঠালি, হাতিশুঁড়ে ছেয়ে আছে জায়গাটি। অতি সাবধানে দীপন একটি ফড়িং ধরে ফেলে। খুশিতে হাততালি দেয় ছোট্ট শীপন। ওদের আনন্দে পূর্ন যতি টেনে দেয় মায়ের তীখ্ন গলা।

নানাবাড়ির রাস্তাটা বেশ ভালোই বলা চলে । রাস্তার দু’ধারে সারি সারি নানা রকমের বৃক্ষের চাদোয়া, ধানক্ষেত, সবজির বাগান, ঝোপঝাড়,বাঁশবাগান, জমির আইলে সার বেধে তালগাছ, মোর্তা, নল, রেশম, কলাগাছ, কচুরিপানা,টোপাপানায় ভরপুর ছোট ছোট ডোবা, তারই পাড়ে হিজলের ঝুলে থাকা যুবতীর লম্বা কানের দুল,হেলে থাকা কয়েকটি সুদীর্ঘ নারিকেল গাছ, ঘন সবুজ কেশদামের ছাতিম, তমাল, জারুল, পেয়ারা, আম আরো কত কী।

আজ ওরা বেজায় খুশি। টোপন, যুবায়ের, লতা, সাদিয়া, মইনুলসহ ওদের বয়সী বেশ কয়েকটা ছেলেমেয়ে জুটে গেল খেলার সাথী হিসাবে। সারাদিন হই-হুল্লোড়, ঘোরাঘুরি আর রাতে নানাভাইয়ের কাছে মজার মজার গল্প শোনা, নানীর হাতের অতুলনীয় স্বাদের পিঠাপুলি, নেই পড়তে বসার ঝামেলা শুধু হেডমাস্টার নানাভাইয়ের কিছু বিরক্তিকর ইংরেজি ট্রান্সলেশন ছাড়া ওদের আনন্দ যে আর ধরে না।

সারাদিন বাড়ীর পিছনের বাগানটাতে চড়ুইভাতি কিংবা চোরপুলিশ খেলা, মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও ভর দুপুরে সড়া ভুতের ভয় কাটিয়ে তেতুল গাছের নিচে খেলা করা, ঢিল ছুড়ে গুটি আম পাড়া, জামের ফুলে গুগগুন করা মৌমাছি, সাদা মুক্তোর মত বাতাবীলেবুর ফুল, চালতা, বরই, আমলকি, করমচা, কাঠাল, বকুল, রেইনট্রি আরো বহু বিচিত্র গাছের আলো আধারি, বাঁশঝাড় প্রভৃতি তারই অল্প দূরে অসংখ্য বুনো ফুলের ঝোপ। কাছে যেতেই সড়সড় শব্দে কিছু একটা সরে যাওয়ার শব্দ পায় ওরা।

ওদিকটাতে যেতে সাদিয়া সবাইকে বারণ করে। ওদের মধ্যে দীপন সবচাইতে বড়। তাই নিজেকে জাহির করার বালকোচিত ভাব পেয়ে বসে তাকে। সাবধানে একটু ঘুরে ঝোপের ওদিকটাতে যেতেই কয়েকটা মৃত মুরগীর বাচ্চা দেখতে পায় সে। আরেকটু এগোতেই ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে। যে দৃশ্যের জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। একটা ছোট্ট মুরগীর বাচ্চাকে ছিড়ে খাচ্ছিল গুইসাপ। চিৎকার দীপনের দু ঠেটের বাইরে আসতে পারে না পিছে পিচ্চিগুলো না হাসাহাসি করে। লজ্জার ভয় আরো তীব্র।

নানাবাড়ির পিছনের দিকে ঝোপটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলেই একটু দূরে গাছপালা সম্মৃদ্ধ একটা পরিত্যক্ত ভিটা। বিশালাকার অশ্বত্থ, শিমুল, কৃষ্নচূড়া, বটগাছ, আম, বানরলাঠি আর করচ গাছে ঢেকে আছে জায়গাটি। সেদিকে কৃষকদের পায়ে চলার একটি পথ রয়েছে। সেই পথ ধরে ওরা এগিয়ে যায় বেশ গা ছমছমে ভিটায়। পথের ধারে শিমুল গাছের গোড়া যেন বসার জন্য বেঞ্চি পেতেছে,অশ্বত্থের ঘনপাতার ছাউনি। জায়গাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য বিঁড়ির ফেলে দেয়া অংশ, পাউরুটির পরিত্যাক্ত প্যাকেট, দিয়াশলাই, ফলের খোসা আর খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ।

বুলবুলি, টুনটুনি, কাঠঠোকরা, বাশকোড়ল, সুইচোরা, কাক আরো নাম না জানা কয়েকটি পাখির আবাস সেখানে। গাছের উচু ডালগুলোতে পাখির বাসা। ভিটার চারপাশ জুড়ে ছিটকিনির ঝোপ। ঝোপের মাথায় ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য বুনো সাদাফুলের লতা। নিচটাতে ইঁদুরের গর্ত, গুইসাপ, বাগডাস, গোখরো সাপের আবাস।

ভিটার পাদদেশে ঢোলকলমি, বিষকাঠালি, দূর্বা, লজ্জাবতী, তুলসী গাছের ছড়াছড়ি। থোকায় থোকায় সাজানো থানকুনি পাতা। পাশেই শর, নলখাগড়া ও কচুরিপানায় ভরা ছোট্ট ডোবায় কৈ, শিং, মাগুর, টাকি, শোল, পুটিসহ নানারকম মাছ, শামুক, ঝিনুক, কুচিয়া, তৃপ্তিতে ডাকতে থাকা ব্যাঙ, ঢোড়াসাপ আরো কত কত প্রাণবৈচিত্র সকলে মিলে যেন স্বাস্থ্যকর এক ইকোসিস্টেম।

নানারকম পাখির কিচিরমিচির শুনতে শুনতে ওরা বুনো ফুল, মরিচের মত দেখতে ছোট ছোট ফল আর কচুড়ির ঢেপ জোগাড় করে মহানন্দে চড়ুইভাতি শুরু করে। যেন সত্যিকার রান্নাকরা খাবার একজন আরেকজনকে খাইয়ে দেয়। খর রৌদ্রের মধ্যে ওরা বেরিয়ে পড়ে সামনের বিশালাকার সবজির ক্ষেতে। সেখানে কলাই, গাজর, মুলা, পেয়াজের সাদা ফুল, রসুন, সরিষার হলুদ ফুল যেন দিগন্তবিস্তৃত, কুমড়া, তরমুজ,বাঙ্গি,শশা শত সহস্র। ফুলে ফুলে রঙ্গিন প্রজাপতি, মৌমাছি আর ফড়িংয়ের ইতিউতি উড়াউড়ি ওদের ক্ষূধা ভুলিয়ে দেয়। খুশিতে ওরা লাফাতে থাকে, চিল্লায়, গড়ান দেয় কলাই ক্ষেতে, বাঁধনহারা, উম্মাতাল সে এক অপার্থিব সুখ। এত আনন্দ ওরা কখনও পায়নি। বহু দূরে ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। গ্রামের রাস্তায় যানবাহন কম তাই যন্ত্রণাও কম।

ওরা ছুটে চলে আরো দূরে যেখানে বিশালাকার ধানক্ষেত নিচু জলাভূমির সাথে মিশেছে। অসংখ্য সাদাবক, কুচিবক ও পানকৌড়ি মিলে ছোট মাছের ভোজনোৎসব যেন। ছোট ছোট কচুরিপানা, শালুক, শাপলা, কলমিলতা, ছোপ ছোপ ঘাসের মাঝে লুকিয়ে থাকা মাছের ঝাঁক জায়গাটিকে মাছরাঙ্গা, বক আর পানকৌড়িদের ভোজনবাড়ী বানিয়েছে। মখমলের মত নরম ঘাসের চাদরে ওরা বসে পড়ে। লম্বা গলা বাড়িয়ে বকেরা মাছ ধরে খায়, পানিতে লম্বা ডুব দিয়ে মাছ ধরে দূরে ভেসে ওঠে পানকৌড়ি।

ডানা ঝাপটায়, ঝরে পড়া পানিতে সূর্যের কিরণ লেগে বর্ণের ছটায় আনন্দে শব্দ করে ওঠে ওরা। ভয় পেয়ে উড়ে দূরে গিয়ে বসে কয়েকটি সাদা বক। কুচিবক নির্বিকার ভয় ডরহীন আয়েশে ঝিমায়।

পাশেই জমির আইলে রাখা শুকনো কচুরিপানার স্তুপের উপর চড়ে বসে ওরা। সড় সড় শব্দে কিছু একটা সরে যায়। ভয় পেয়ে সবাই একসাথে দৌড়ায়। আইলের কাদাপানি মিশ্রিত ছোট্ট ভাঙ্গা অংশটি লাফিয়ে পেরোয়। দৌড়িয়ে খালপাড়ের উচু অংশটিতে পৌছায় যেখানে একটি জারুল ও খালের পানিতে ঝুকে থাকা কয়েকটি হিজল গাছের আত্মীয়তা। খালের স্বচ্ছ পানিতে অসংখ্য ছোট মাছের নাচানাচি ওদের আনন্দ বাড়িয়ে দেয়। কেউ একজন ঢিল ছুড়তেই পানিতে চারিদিকে ছোট ছোট ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। দূরে হতে নানাভাইয়ের গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। এতোক্ষণে ক্ষূধাটাও অস্তিত্ব জানান দেয়। মায়ের বকুনির শঙ্কাও জেগে ওঠে।

দ্রুত পায়ে নানাভাই ওদের কাছে চলে আসে। আদর করে কাছে টেনে নেয় নাতিদের। রোদে পুড়ে কী হালটাই করেছে চেহারার। তারপরও নানাভাই ওদের উপর রাগ করে না। আহা কতদিন পরে ওরা গ্রামে এসেছে আর কতদিন পর আবার আসবে কে জানে। এ মাটি ,মায়া, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য না দেখলে জীবনটাই যে বৃথা তা বেশ ভালোভাবেই জানে মাস্টার সাহেব নানাভাই। রোখসানা বেগম কড়া ধমক দেয় ছেলেদের-ধুলো ময়লা, রোদে পোড়া শরীর দেখে। নানাভাইয়ের প্রশ্রয়ে বেঁচে যায় সে যাত্রা।

নানাবাড়ির মজার মজার খাবার, ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানো, নানাভাইয়ের মুখে শোনা রুপকথার গল্প সব নিমিষেই ম্লান হয়ে যায় যখন শুনতে পায় ওরা আজ বিকেলেই ঢাকায় ফিরবে। প্রবল দুঃখে কেঁদে ফেলে ওরা।

যথাসময়ে রওয়ানা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে ইট পাথরের জঞ্জালে। গাড়ী ছুটছে সাই সাই করে। দু চোখ ভরে ওরা দেখতে থাকে শ্যামল বাংলা, গ্রাম্য সবুজ মেঠোপথ,প্রাণ প্রাচূর্যে ভরা চারপাশ। আর কি কখনও হবে ফেরা। মায়ের ডাক ওরা শুনতে পায় না। তন্ময় হয়ে যেন মদিরায় ডুবে আছে, যেন আর কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। ড্রাইভার আফজাল মিয়া বেশ দক্ষতার সাথে ওদের শরীরকে টেনে নিয়ে যায় তিলোত্তমা শহরের দিকে কিন্তু মনকে আটকায় এমন সাধ্য কার। সে ফিনিক্স কিংবা গারুদার মত বিচরণ করে স্বপ্নরাজ্যে।

লেখক : নাজিম হোসেন শেখ,সহকারী পরিচালক,পরিবেশ অধিদপ্তর , চাঁদপুর । ১২ জুন ২০২১