চাঁদপুর জেলার মতলব বিশ্বদরবারে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে এখানে চলমান হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভিল্যান্স সিস্টেমের (এইচডিএসএস) কারণে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এইচডিএসএসের মাধ্যমে চার প্রজন্মের তথ্য-উপাত্ত (ডেটা) সংরক্ষণ করে রেখেছে। সংগ্রহ ও সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। এখনো তা চলছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, জনস্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা গবেষণার এত বড় ও দীর্ঘস্থায়ী ‘ফিল্ড সাইট’ বিশ্বে বিরল।
কলেরা গবেষণায় আইসিডিডিআরবির স্বীকৃতি বিশ্বজোড়া। ওই গবেষণায় বড় ভূমিকা রেখেছিল মতলবের উপাত্ত। কলেরা নিয়ন্ত্রণে মাংসপেশিতে দেওয়া ইনজেকশন যে অকার্যকর, তা প্রমাণিত হয় মতলবে। আবার খাওয়ার স্যালাইন যে কার্যকর, তা-ও প্রমাণিত হয়েছে মতলবে। জিংক বা দস্তা ব্যবহার করে ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণের উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয় এখানে। বাংলাদেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে, তার দিশারি গবেষণা হয়েছিল মতলবেই।
আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক বা জনমিতিক বিশ্লেষণ ও নীতিনির্ধারণে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্তের বিকল্প নেই। জন্ম, মানুষের জীবনযাপন, কেন মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়—এই ধরনের তথ্য-উপাত্ত দীর্ঘদিন ধরে দিয়ে চলেছে মতলব এইচডিএসএস। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই এর যৌক্তিকতা রয়েছে।’
তথ্যের বিপুল ভান্ডার
এইচডিএসএসের মাধ্যমে মতলবের ১৪২টি গ্রামের ২ লাখ ৪৫ হাজার মানুষের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যার তথ্য-উপাত্ত নিয়মিত সংগ্রহ করছে আইসিডিডিআরবি। প্রতি তিন মাস অন্তর এসব তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদ করা হয়।
ডেমোগ্রাফিক বা জনমিতিবিষয়ক ছয় ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে আছে: জন্ম, মৃত্যু, গমনাগমন, বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ ও পরিবারপ্রধানের পরিবর্তন। স্বাস্থ্যবিষয়ক পাঁচ ধরনের তথ্যের মধ্যে আছে: নারীর প্রজনন পরিস্থিতি, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার, স্বামীর অবস্থান, শিশুকে খাওয়ানোর অভ্যাস এবং মা ও শিশুর টিকা পরিস্থিতি। এ ছাড়া প্রতিটি বাড়ি, রাস্তা-খাল-নদী-ডোবা, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও নলকূপের অবস্থানের তথ্য জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নেওয়া হয়।
মাঠ থেকে ঢাকায়
আইসিডিডিআরবি মতলবের ১৪২টি গ্রামকে দুই ভাগ করেছে। প্রথম ভাগে চারটি ব্লক। এই চার ব্লকের ৬৭ গ্রামে আইসিডিডিআরবির মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেওয়া হয়। অন্য ৭৫টি গ্রাম তিনটি ব্লকে ভাগ করা। এই ব্লকগুলোতে আইসিডিডিআরবির কোনো সেবা নেই। ব্লকগুলো ইউনিটে বিভক্ত। প্রতিটি গ্রামের জন্য পৃথক সাংকেতিক (কোড) নম্বর রয়েছে এবং প্রতিটি নাগরিকের জন্য পৃথক পরিচিতি (আইডেনটিটি) নম্বর আছে।
১৪২টি গ্রামের তথ্য নিয়মিত সংগ্রহ করেন ৪২ জন মাঠকর্মী। ছয়জন মাঠকর্মীর কাজের তদারক করেন সুপারভাইজার। সুপারভাইজার সংগৃহীত তথ্যের মানও যাচাই করেন। সুপারভাইজারদের কাজের তদারক করেন ফিল্ড রিসার্চ অফিসার। আর পুরো কাজে নজরদারি করেন এইচডিএসএসের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক। বর্তমানে এখানে চিকিৎসক, নার্স, গবেষক, পরিসংখ্যানবিদ, ব্যবস্থাপক, স্বাস্থ্য সহকারী, মাঠকর্মী মিলে প্রায় ৭০০ মানুষ কাজ করেন।
শুরুতে ছাপানো ফরমে ও বাঁধানো খাতায় তথ্য সংরক্ষণ করা হতো। এখন তথ্য সরাসরি কম্পিউটারে তোলা হয়। পুরোনো খাতার তথ্যও কম্পিউটারে ঢোকানো হয়েছে। খাতাগুলো সংরক্ষিত আছে। বর্তমানে মাঠ থেকে সরাসরি উপাত্ত জমা হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে।
সঙ্গে আছে সেবা
৫০ বছর ধরে এলাকার মানুষ আইসিডিডিআরবিকে তথ্য দিচ্ছে। এর একটি প্রধান কারণ, প্রতিষ্ঠানটির ওপর তাদের আস্থা। দীর্ঘদিন সেবা দিয়ে আইসিডিডিআরবি এই আস্থা অর্জন করেছে।
খাওয়ার স্যালাইন আবিষ্কারের পর আইসিডিডিআরবির ওপর মানুষের আস্থা বেড়ে যায়। নিজেরাই ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা শিখে যায়। এরপর শুরু হয় পরিবার পরিকল্পনা সেবা। তারপর শুরু হয় মতলব হাসপাতালে মা ও শিশুর চিকিৎসা।
মতলব হাসপাতাল ছাড়াও চারটি ব্লকে চারটি পৃথক উপকেন্দ্র আছে। এসব উপকেন্দ্রে মা ও শিশুস্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেওয়া হয়। এতে ২৪ ঘণ্টা প্রসবসেবার সুযোগ আছে। এ ছাড়া ৪১ জন কর্মীর বাড়িতে ৪১টি ক্লিনিক (ফিল্ড সাইট ক্লিনিক) আছে। এখানে শিশুদের টিকা দেওয়া হয়। পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিতেও নারীরা আসেন।
মাসে দুবার স্বাস্থ্য ও এইচডিএসএসের মাঠকর্মীরা উপকেন্দ্রগুলোতে সভা করেন। সেই সভায় কোন বাড়িতে নতুন বিয়ে হয়েছে, কোন বাড়িতে কোন মহিলা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন, কোন বাড়িতে প্রসব হয়েছে, কে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে, কোন বাড়িতে মৃত্যু হয়েছে, তা আলোচনা ও তথ্য আদান-প্রদান হয়। সেই তথ্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি সেবা পৌঁছে দেন। স্বাস্থ্যসেবা ও এইচডিএসএস একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।
জনস্বাস্থ্যের পীঠস্থান
বর্তমানে মতলবে এক ডজনের বেশি গবেষণা চলছে। এর মধ্যে পানিতে ডোবা প্রতিরোধ, আর্সেনিকের প্রভাব, টিকা, পুষ্টি বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হচ্ছে।
মতলবের তথ্য শুধু যে পেশাদার গবেষকেরা ব্যবহার করেন, তা নয়। দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থীরা উচ্চতর ডিগ্রির জন্য মতলবের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেন। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০টি পিএইচডি (১০ জন বিদেশি) ও ৫০টি মাস্টার্স থিসিসে মতলব এইচডিএসএসের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্তের জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বর্ণনা করে আইসিডিডিআরবি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হয়। বিদেশি গবেষকদের আবেদনের সঙ্গে গবেষণা প্রটোকল জমা দিতে হয়। তবে গবেষণা সহযোগী হিসেবে আইসিডিডিআরবির কমপক্ষে একজন গবেষককে সঙ্গে রাখতে হয়।
দেশি-বিদেশি বহু গবেষণায় তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারের কারণে বিশ্বব্যাপী মতলব এইচডিএসএস পরিচিতি পেয়েছে। মতলবের আদলে ফিল্ড সাইট তৈরির উদ্যোগও একাধিক দেশে নেওয়া হয়েছে। উদাহরণ তৈরি করেছে আফ্রিকার ঘানা। দেশটি ১৯৯৮ সালে আইসিডিডিআরবির আদলে ‘ঘানা কমিউনিটি হেলথ সিস্টেম’ চালু করে। তা ছাড়া এই ধরনের উদ্যোগ একত্র করে ‘ইনডেপথ নেটওয়ার্ক’ গড়ে উঠেছে। আইসিডিডিআরবি সেই নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক আহমেদ মোস্তাক রাজা চৌধুরী বলেন, মতলব এইচডিএসএস থেকে নিয়মিত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। পরিসংখ্যান ব্যুরো জন্ম-মৃত্যুর তথ্য দেয় বটে তবে মতলবের মতো এত বিস্তারিত তথ্যের উৎস আর নেই। বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ জনস্বাস্থ্যবিদদের প্রায় সবাই মতলব ঘুরে দেখেছেন, না হয় সেখানে কাজ করেছেন। মতলব হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের জনস্বাস্থ্যের অন্যতম কেন্দ্র। (সূত্র: প্রথম আলো)