আলী আকবর খাঁ নামে কলকাতার একজন পুস্তক ব্যবসায়ী ছিলেন। তার বাড়ি ছিল কুমিল্লার দৌলতপুর গ্রামে। আলী আকবর খাঁ নজরুলের সাহিত্য প্রতিভার কথা জেনে বা বুঝে তাঁর প্রতি ভীষণ আকৃষ্ট হন। আলী আকবর যার একজন বিধবা বোনের একটি মেয়ে ছিল। তাঁর নাম ছিল সৈয়দ আসা খাতুন। ডাক নাম নার্গিস। নার্গিস নামটি প্রিয় কবি নজরুল বিয়ের আগেই দেন। দেখতে খুবই রূপসী ছিলেন। নার্গিসকে দেখেই কবি ভীষণ মুগ্ধ হন। আলী আকবর যার প্রস্তাবে তিনি রাজি হন।
বিয়ের দিন ধার্য করা হয় ১৩২৩ বঙ্গাব্দের ৩ আষাঢ়,১৯২১ সালের জুন মাসে। তার বিভিন্ন নজরুল গবেষকগণ এ ভিন্ন মতামতও দেন বলে জানা গেছে। যাহোক, কেউ কেউ বলেন বিবাহ সম্পন্ন হয়নি আবার কেউ বলেন-বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে। তার মূলত: আলী আকবর খাঁ তিনি চেয়েছেন নজরুলকে তাদের বাড়িতে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু নজরুল কোনো মতেই রাজি হননি। যার ফলে নজরুল নার্গিসের দাম্পত্য জীবন গড়া সম্ভবপর হয়নি বলে জানা যায়।
পরে নার্গিস আই.এ পাশ করেন। তিনি ‘তহমিনা’ নামে একটি উপন্যাস রচনা ও প্রকাশ করেন। নার্গিস বহুকাল (১৯২১-১৯৬৭) সাল পর্যন্ত অবিবাহিত ছিলেন। অত:পর ১৯৩৭ সালে ৩০ বছর বয়সে আলী আকবর খানের দোকানের কর্মচারী কবি আজিজুল হাকিমের সাথে তাঁর বিয়ে হয়।
এ সময় নজরুল চলে আসেন কুমিল্লায়। কুমিল্লার কান্দিরপাড় নামক স্থানে ইন্দোমহন সেন গুপ্তের সহধর্মীণি বিরূজা সুন্দরীর সাথে পরিচয় হয় কোনো এক ঘটনা চক্রে। ঔ রমনীকে তিনি মা বলে ডাকতেন। ইন্দো কুমারের বড় ভাই ছিলেন বসন্ত কুমার। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল গিরিবালা দেবী। তাঁর একজন কন্যা ছিলেন আশালতা। পুরো নাম আশালতা সেনগুপ্ত। তার ডাক নাম ছিল দুলি বা দোলন।
কবি নজরুল তাকে দেখে ভালোবেসে ফেলেন। তাঁকে ঘিরেই তাঁর অনেক কবিতা,গান ও দোলনচাঁপা নামের কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়। আশালতাও নজরুলকে দেখে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেন। কিন্তু মা বলে ডাকা বিরোজা সুন্দরী মুসলমান ছেলের সাথে দুলির বিয়ে হউক এটা তিনি চাননি। কিন্তু গিরিবালা সম্ভবত: আশালতার মা তাদের বিয়ের বিষয়ে সম্মত হন। এখানে সবচেয়ে বেশি সমস্যা ছিল তৎকালীন হিন্দু সমাজে এ বিয়ে সম্পন্ন করা খুবই কঠিন ছিল।
ফলে-গিরিবালা নজরুলকে বললেন,‘কলকাতায় বাসা ভাড়া করে তাকে জানাতে। খবর দিলেই তিনি আশালতাকে সেখানে নিয়ে যাবেন।’ কথামত কলকাতার হুগলীর হাজী লেনে বাসা ভাড়া করা হয়। গিরিবালা দেবী আশালতাকে নিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। বিয়ের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব নিলেন তৎকালীন হুগলীর সরকারি উকিল-মযহারুল আনোয়ার চৌধুরীর কন্যা-এফ রহমান। তিনি মা ও মেয়ে উপন্যাসের লেখিকা ছিলেন। নজরুলকে ছেলেরই মতই তিনি স্নেহ করাতেন।
১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল ১২ বৈশাখ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ আশালতা নজরুলের বিয়ে সম্পন্ন হলো। নজরুল বিয়ের পর আশালতার নাম দিলেন ‘ প্রমীলা’। তখন প্রমীলা ছিল একজন ষোড়শী। সেই থেকে প্রমীলা থেকে প্রমীলা নজরুল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁদের বিয়েটি মুসলিম রীতিতে হলেও প্রমীলা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি। গিরিবালা দেবিকেও আর ফিরে যাওয়া হয়নি। তিনি থেকে যান জামাই মেয়ের সঙ্গে। প্রায় দু’বছর এখানে ছিলেন। এখানেও কবিকে আর্থিক দৈন্যদশায় দিন কাটাতে হয়। কেননা কবি তো ছিলেন সংসার চালাতে অদক্ষ।
প্রিয় কবি নজরুরের নির্দিষ্ট কোনো উপার্জন ছিল না। তাই সংসার চালাতে কবিকে হিমশিম যেতে হয়। পত্র-পত্রিকাও প্রকাশকগণ যা দিতেন তাই দিয়েই তিনি সংসার চালাতেন। তবে মিসেস এফ রহমান তাকে সাধ্যমত সহায়তা করতেন। ১৯২৫ সালেই তার প্রথম পুত্র আজাদ কালামের জম্ম হয়। তার নাম ডাক নাম রাখা হয়- কৃষ্ণ মোহাম্মদ। কয়েক মাসের মধ্যেই কৃষ্ণ মোহাম্মদ মারা যায়।
২৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি চলে আসেন কৃষ্ণ নগর। এ বছরের ৯ সেপ্টেম্বর তার দ্বিতীয় পুত্র অরিন্দম খালেদ জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম অপর নাম ছিল বুলবুল। কবি তাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। ৪ বছর বয়সেই সে গান গাইতে পারতেন। এ সময় ১৯২৬ সালে ‘লাঙল পত্রিকাটি গণবাণী’ নামে প্রকাশিত হত। প্রথম গজল ‘বাগিচার বুলবুলি তুই’ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তিনি কেন্দ্রিয় আইন সভার নির্বাচনে প্রার্থী হন। ভোট প্রার্থী হিসেবে তিনি মুসলিম সাহিত্য সমাজ এর বার্ষিক আমন্ত্রিত পেয়ে আত্মপ্রকাশ হলেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে। সে সুবাধে ঢাকায়ও আসেন।
জুন মাসে নওরোজ পত্রিকায় যোগদান করেন। নওরাজ ছেড়ে আবার নভেম্বর মাসে নাছির উদ্দিনের সওগত পত্রিকায় যোগদান করেন। ১৯২৮ সালে কলকাতার একটি গ্রামোফোন কোম্পানীর সাথে সঙ্গীত রচিয়তা ও প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দান করেন।
১৯৩২ সাল পর্যন্ত এ কোম্পানীতে ছিলেন। এছাড়াও বেতার ও মঞ্চের সাথে সংযুক্ত হন। ১৯২৮ সালে তাঁর মা জাহেদা খাতুন মৃত্যুবরণ করেন। চল চল চল গান রচনা ও ১৯২৯ সালে রংপুরে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।
১৯২৯ সালে কলকাতার এলবার্ট হলে কবি নজরুলকে বাঙালী জাতির পক্ষে সংবর্ধনা পান। এছাড়াও তার তৃতীয় পুত্র কাজী সব্যসাচী ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। তার ডান নাম ছিল সানী। ১৯৩০ সালের ৪ বছর বযসে কোনো এক মাসে বুরবুল বসন্তযোগে মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল ছেলের শোকে খুবই ভেঙে পড়েন। এ সময় ‘চন্দ্রবিন্দু’ ও ‘প্রলয় শিখা’ কবিতাগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়। গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে তাকে ৬ মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়। আরডুইন চুক্তির ফলে নজরুলের জেল বা কারাগার হয়নি ।
১৯৩১ সালে কবি নজরুলের কনিষ্ঠ পুত্র অনিরুদ্ধের জন্ম হয়। ত্াঁর ডাক নাম ছিল নিনি। সব্যসাচীর দু’স্ত্রী ছিলÑএকজনের নাম ছিলো-উমাকাজী ও ড.অঞ্জলী মুখার্জী। আর অনিরুদ্ধের স্ত্রীর নাম ছিল- কল্যাণী কাজী। এ সময় সুরভান্ডারী হিসেবে মর্ডাণ থিয়েটারস লি. তিনি যোগদান করেন। উমা কাজী সেবিকা হিসেবে এসেছিলেন। নজরুলের কোনোই কন্যা সন্তান ছিল না। তবে শান্তি লতা দেবী নামে একজন পালক মেয়ে ছিল।
তথ্যসূত্র : মো.হাবিবুর রহমান রচিত ‘ছোটদের নজরুল, নবারূণ ও বাংলাদেশ সচিত্র মাসিক প্রত্রিকা ,শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত -‘নজরুল জীবনের ট্য্রাজেডি’,ডা.আনিস আহমেদের সম্পাদনায় ‘ কাজী নজরুলের জীবনী’ এবং ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত ছবি) (৮ম পর্ব শেষ – চলবে আরও ক’টি পর্ব )
লেখক : আবদুল গনি , শিক্ষক, সাংবদিক ও সাধারণ সম্পাদক , নজরুল গবেষণা পরিষদ , চাঁদপুর। ০১৭১৮ ২১১-০৪৪, ২০ মে ২০২১
ূ