Home / সারাদেশ / ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যা করতে হবে
Capture-..

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যা করতে হবে

শতবর্ষী ডেলটা প্ল্যান ২১০০ তথা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের সকল বিভাগ,মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করাটাই প্রথম কাজ। আর এ জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড,হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতর,পরিবেশ অধিদফতর, মৎস্য অধিদফতর,কৃষি,
এলজিইডি,বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

আগে বাঁধ

বলা হয়েছে,জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ততা রয়েছে নদী, জলোচ্ছ্বাস ও বাঁধের। জলবায়ু পরিবর্তনে অতিবৃষ্টি,খরা,বন্যা, জলোচ্ছ্বাস সবই বেড়ে যাবে। বাঁধও ভেঙে যেতে পারে। তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আছে ফসলি জমি,বাড়িঘর ও লোকালয়। বিপদের আশঙ্কায় থাকা জনগোষ্ঠীকে বাঁচাতে সরকারের শতবছরের ডেলটা প্ল্যানে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় তাই বাঁধের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সবার আগে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।

কেন ব-দ্বীপ পরিকল্পনা

২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ অনুমোদন পায়। এর আগের ৪৭ বছরে দেশে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, কৃষি উন্নয়নে বহু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এরপরও ব-দ্বীপ পরিকল্পনা কেন?

জবাবে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন,স্বাধীনতার পর যতো পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল,সবই ছিল বিচ্ছিন্ন। ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় সারা দেশকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।দেশের নদ-নদী, জলাভূমি, মাটি, পাহাড়, সমতল, হাওরসহ যাবতীয় প্রাকৃতিক ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করে এ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এমনকি এটি চূড়ান্ত করার আগে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ-প্রতিবেশ, বিনিয়োগ, অর্থায়ন ইত্যাদি বিষয়ে ২৬টি বেইজ লাইন সমীক্ষাও করতে হয়েছে।

একনজরে ব-দ্বীপ কাঠামো

ডেলটা প্ল্যানের বিবরণে জানা গেছে, ব-দ্বীপের অবকাঠামো এলাকা হচ্ছে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্লাবন ভূমি ৮০ শতাংশ। পাহাড়ি অঞ্চল ১২ শতাংশ এবং সোপান এলাকা ৮ শতাংশ।

পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মিলনস্থলে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে গতিশীল এই ব-দ্বীপ। এ ছাড়া দেশে রয়েছে ছোটবড় প্রায় ৭০০ নদী। এর মধ্যে ৫৭টি আন্তঃদেশীয় নদী। ৫৪টি ভারতের সঙ্গে ও ৩টি নদী মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত।

১১ চ্যালেঞ্জ

পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে, ডেলটা প্ল্যান বাস্তবায়নে বাংলাদেশের জন্য সামনে ১১টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আইপিসিসি-এআর প্রতিবেদন ও সমীক্ষা অনুযায়ী চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে-

১। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা (২০৫০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বাড়ার আশঙ্কা ১ দশমিক ৪ থেকে ১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বোচ্চ ২ ডিগ্রি ছাড়াতে পারে,

২। বৃষ্টিপাতের তারতম্য (সামগ্রিকভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে বৃষ্টিপাত বাড়বে। তবে দেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে কমার আশঙ্কা আছে।)

৩। অতিবৃষ্টির আশঙ্কা

৪। খরা

৫। নদীভাঙন (প্রতিবছর নদীভাঙনে ৫০ হাজার ভিটা বিলীন হচ্ছে।)

৬। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে দেশের ভেতর লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ (লবণাক্ততা ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ এলাকায় ১ পিপিটি এবং ২৪ শতাংশ এলাকায় ৫ পিপিটি বাড়তে পারে)

৭। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস

৮। জলাবদ্ধতা

৯। পলি

১০। আন্তঃদেশীয় নদী ব্যবস্থাপনা

১১। পৃথিবীর দুর্যোগপূর্ণ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ

অরক্ষিত বন্যাকবলিত এলাকা

পরিকল্পনা কমিশন মনে করে, এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমেই আমাদের অভিন্ন ৫৭টি নদীর সন্তোষজনক অগ্রগতি দরকার। তথ্যবিনিময়ের মাধ্যমে নদী সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে অভিন্ন নদীর সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনৈতিক ও প্রায়োগিক দক্ষতা দুটিই প্রয়োজন।

যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) সক্ষমতা বাড়ানোরও তাগিদ দিয়েছে জিইডি। এ ছাড়া উজানের দেশগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে ভাটির দেশ বাংলাদেশ। এটি মোকাবিলায় কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর জোর দিতে বলেছে কমিশন।

উজানের পানিপ্রবাহের বাস্তবতা বিবেচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতে দেশের ভেতর বাঁধ নির্মাণ করা যেতে পারে। তবে পানিসংক্রান্ত সমস্যা কূটনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে।

বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া; এ সাত জেলার ৪০টি উপজেলাজুড়ে ভাটি অঞ্চল বিস্তৃত। পুরো অঞ্চলে সুতোর মতো ছড়িয়ে আছে অগণিত হাওর-খাল-বিল-নদী-নালা। এসব ব্যবস্থাপনার জন্য নিতে হবে প্রকল্প।

পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ধরলা, আড়িয়াল খাঁ, কুশিয়ারা, গড়াই, মনু নদীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীতে ড্রেজিং কার্যক্রম পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

নদীতে বন্যা ও পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে কোনও কার্যক্রম গ্রহণের আগে ডুবোচর ব্যবস্থাপনার দিকেও নজর দিতে হবে।
নিয়মিত খননের মাধ্যমে নদীর প্রবহমানতা এবং নৌ-চলাচল চালু রাখা সম্পর্কিত কার্যক্রমও ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

বর্ষায় নদীর অতিরিক্ত পানি দ্রুত সরিয়ে নেয়ার সুবিধা রেখে বাঁধ ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম নিতে হবে।

উজানের নদীগুলো থেকে পানি সরিয়ে নেয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। উজানের পানি প্রবাহের বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে প্রয়োজনে দেশের অভ্যন্তরে সম্ভাব্য বাঁধ নির্মাণ করা যেতে পারে।

নদীর ভাঙা-গড়া এবং সময়ের আবর্তনে গতিপথ পরিবর্তনের বিষয়টিও স্বাভাবিক বিবেচনা করে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম মহপরিকল্পনায় রাখতে হবে।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততার আধিক্য ব্যবস্থাপনার জন্য এই মহাপরিকল্পনায় ফলপ্রসু কৌশল নিতে হবে।
সুন্দরবন অঞ্চলে ঘসিয়াখালী চ্যানেলে নিয়মিত ড্রেজিংয়ের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।

বালুমহল এবং পলি বা ড্রেজিং থেকে পাওয়া মাটি বা বালু ব্যবস্থাপনার বিষয়েও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার দরকার হবে।একইসঙ্গে দেশের প্রাকৃতিক জলাভূমি সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতিমালা বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।

বর্জ্যের শ্রেণিবিভাগ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। ইলেকট্রনিক বর্জ এবং মেডিক্যাল বর্জ্যের বিষয়ে আলাদা কৌশল নিতে হবে।

সুন্দরবনের উন্নয়নে কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করে সবুজ বেষ্টনী গড়া, দ্বীপগুলোর উন্নয়ন এবং হাওর অঞ্চলে পানিসম্পদ ও নদী ব্যবস্থাপনা, মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের বিষয়ৈ সুনির্দিষ্ট কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। জলাবদ্ধতা দূর করার পরিকল্পনা নিতে হবে।

নদী ও উপকূলে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা নতুন চর উন্নয়ন ও জমি পুনরুদ্ধারে গুরুত্ব দিতে হবে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়নের জন্য নতুন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো (ডেলটা কমিশন) সৃষ্টি না করে এর বাস্তবায়ন ও সার্বিক সমন্বয়ের জন্য সাধারণ অর্থনীতি বিভাগকে দায়িত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এ বিভাগে একটি আলাদা অনুবিভাগ গঠন করতে হবে।

জমি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর শতবছর মেয়াদী বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা (ডেল্টা প্ল্যান ২১০০) গ্রহণ করে। মহাপরিকল্পনাটি গ্রহণ করা হয় ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসের ব-দ্বীপের আদলে। ২৬টি গবেষণাপত্র তৈরি করে চার বছর ধরে সেগুলোর ওপর অর্থনীতিবিদ,পানি,জলবায়ু বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক শেষে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,ডেলটা প্ল্যান তথা ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় ২০৩১ সাল পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ৮০টি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫টি ভৌত অবকাঠামোর প্রকল্প ও ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও গবেষণা বিষয়ক। বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে তিন লাখ কোটি টাকারও বেশি।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী ও ডেলটা কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ মান্নান জানিয়েছেন,এ পরিকল্পনা একটি আমব্রেলা প্রকল্প। এর মধ্যে কোনওটি দ্বিবার্ষিক,কোনওটি পঞ্চবার্ষিকী আবার কোনওটি ২০ বছর মেয়াদী। করোনাকালেও থেমে থাকেনি এ প্রকল্পের কাজ। কিছু কিছু উন্নয়ন প্রকল্প এখনও চলমান।

বার্তা কক্ষ , ৬ মে ২০২১