প্রাচীনকাল থেকেই বরিশাল ছিল প্রাচুর্যের অধিকারী। ফল-ফসলে বিখ্যাত হয়ে ওঠার কারণে এ জেলার নামের সাথে ‘শস্য ভাণ্ডার’ তকমাটি যুক্ত হয়েছে। কিন্তু অসংখ্য নদ-নদী ঘেরা এই জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা কোনোকালেই ভাল ছিল না। ব্রিটিশ শাসনের ভিত মজবুত হওয়ার পর যখন সারাদেশে দ্রুততম রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হতে থাকল, তখনও বরিশালের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটল না। এ অঞ্চলের মানুষকে তখনও নির্ভর করতে হলো নৌপথের উপর।
বরিশালে কোনোকালেই রেলপথ ছিল না। এখানে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, ইতিহাস ঘেঁটে এমন তথ্যও পাওয়া যায় না। কিন্তু এ দেশের রেলওয়ের ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’ নামক হারিয়ে যাওয়া এক ট্রেনের নাম। এদেশের মাটিতেই সদম্ভ পদভারে ছুটে চলত বরিশাল এক্সপ্রেস। তবে ট্রেনটি বরিশালে যেত না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশের কথা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তখন রেলপথ নির্মিত হচ্ছে। শিয়ালদহ থেকে দর্শনা হয়ে গোয়ালন্দ ও শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হয়েছে অনেক আগেই। ট্রেন চলাচলের ফলে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলেফেঁপে উঠেছে। এদিকে যশোর ও খুলনা অঞ্চল তখন বেশ সমৃদ্ধ। তাই ব্রিটিশ সরকার খুলনা অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করল।
বেনাপোল থেকে খুলনা পর্যন্ত রেলস্টেশনসমূহ
লন্ডনে প্রতিষ্ঠা করা হলো ‘বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে কোম্পানি’। মূলত এটি ছিল ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের একটি সহায়ক কোম্পানি। ইউরোপে তখন রেলওয়ে ব্যবসা খুব জমজমাট। তাই বিনিয়োগ পেতেও অসুবিধা হলো না। কোম্পানির সাথে সরকারের চুক্তি হলো, সকল খরচ-খরচা বাদ দিয়ে যা লাভ হবে, তার পাঁচ ভাগের একভাগ সরকার পাবে। বাকিটা কোম্পানির থাকবে। মজার ব্যাপার হলো, কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ছিল বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রথসচাইল্ড পরিবার। আর নাথানিয়েল মায়ের রথসচাইল্ড ছিলেন বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে কোম্পানির একজন স্বত্বাধিকারী।
আনুষ্ঠানিক ঝামেলা শেষ হওয়ার পরই কোম্পানিটি পুরোদমে কাজে লেগে গেল। সময়টা ছিল ১৮৮১ সালের জুলাই মাস। কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হলো শিয়ালদহ থেকে বেনাপোল, যশোর হয়ে খুলনা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করতে হবে। প্রথমে রানাঘাট থেকে বনগাঁও পর্যন্ত ২০ মাইল রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রম সমাপ্ত হয়। এরপর দমদম থেকে দত্তপুকুর হয়ে বনগাঁও পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ শেষ হয়। সর্বশেষ বনগাঁও থেকে যশোর হয়ে খুলনা পর্যন্ত ৬২ মাইল রেলপথ নির্মাণ সম্পন্ন হয় ১৮৮৪ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে গেলে বরিশাল এক্সপ্রেস একটি আন্তর্জাতিক ট্রেনে পরিণত হয়। তখন বেনাপোল এবং পেট্রাপোলে দু’দফায় যাত্রীদের ভিসা এবং পাসপোর্ট চেক করা হতো। সেসময় ইস্ট বেঙ্গল মেইল এবং ইস্টার্ন বেঙ্গল এক্সপ্রেস নামে আরো দুটি ট্রেন দুই দেশের মধ্যে চলাচল করত। আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৫ সালে শুরু হলো পাক-ভারত যুদ্ধ। এর জের ধরে বরিশাল এক্সপ্রেসসহ বাকি দুটি ট্রেনও বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ৫২ বছর পর, ২০১৭ সালে কলকাতা-খুলনা রুটে নতুন করে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। তবে এই ট্রেনের নাম ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’ নয়, ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’।
কালের পরিক্রমায় কত কিছুই হারিয়ে যায়, বদলে যায়, নতুন কিছু তার জায়গা দখল করে নেয়। বরিশাল এক্সপ্রেসের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। কিন্তু স্মৃতিবিজড়িত সেই সবুজ রঙের ট্রেনটি আজকেও হয়তো অনেকের স্মৃতির পাতায় নাড়া দেয়। ধোঁয়া ওড়ানো স্টিম ইঞ্জিনের বদলে রেলওয়ে ব্যবস্থাতেও আধুনিকতা এসেছে, উন্নত হয়েছে প্রযুক্তি, বেড়েছে ট্রেনের গতি। পাশাপাশি অম্লান হয়ে গেছে অনেক কিছুই। কিন্তু বাংলার রেলওয়ে ইতিহাসে বৈদ্যুতিক পাখাবিহীন বরিশাল এক্সপ্রেসের নাম চিরস্মরণীয় হয়েই থাকবে।
ঢাকা চীফ ব্যুরো,২০ এপ্রিল,২০২১;