Home / ইসলাম / শিরক : ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ
শিরক : ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ

শিরক : ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ

ইসলাম ডেস্ক | আপডেট : ০১:৩০ অপরাহ্ণ, ২৩ জুলাই ২০১৫, বৃহস্পতিবার

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। সৃষ্টির সব অর্থবহ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় মানুষের মাধ্যমে। আল্লাহর জমিনে এমন কোনো কাজ নেই যা আল্লাহ জানেন না। আল্লাহর জমিনের সব কর্মই ইবাদত। শর্ত হচ্ছে, প্রত্যেকটি কাজকে যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। তাইতো আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, আমি মানুষকে আমার ইবাদতের উদ্দেশ্য ব্যতিত অন্য কোনে কারণে সৃষ্টি করিনি। অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করার জন্যই আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকটি কাজ যখনই যথাযথভাবে আদায় হবে, তখনই তা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। পাশাপাশি লক্ষ্য ও উদ্দেশের ব্যতিক্রম কোনো কার করলেই তা হবে অবাধ্যতা।

ইবাদতের পাশাপাশি অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকেও নির্দেশ দিয়েছেন। অবাধ্যতা তথা পাপ কাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় অবাধ্যতা হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে শিরক। যা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় শিরক সবচেয়ে বড় জুলুম। শিরকের ভয়াবহতা সম্পর্কে চাঁদপুর টাইমস পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

শিরক কি?
শিরক হচ্ছে অংশীদার স্থাপন, একত্রিকরণ, দুই বা দুয়ের অধিক অংশীদারীর সংমিশ্রণ। অর্থাৎ কোনো জিনিসের অংশবিশেষ যখন একজনের হয়, তখর এর অবশিষ্টাংশ হয় অপর এক বা একাধিকজনের। আল্লাহ বলেন, তবে কি আকাশমণ্ডলীতে তাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে? (সূরা আহকাফ : আয়াত ৪)

পরিভাষায় কুরআন সুন্নাহতে আল্লাহর যে সমস্ত নাম ও গুণাবলী উল্লেখিত হয়েছে সেগুলোকে অবিশ্বাস করা। যে সকল কাজের জন্য (ইবাদত ও আমলের) আল্লাহ বান্দাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাতে তাঁর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত করা থেকে বিরত থাকা এবং বিরত রাখা সর্বোপরি আল্লাহর কৃতকর্মে অস্বীকার করা। পাশাপাশি গাইরুল্লাহকে মা’বুদ ও মান্যবর হিসেবে গ্রহণ করা।

আল্লাহ বলেন,
ক. সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর যিনি সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতিপালক। (সূরা ফাতিহা)
খ. আল্লাহর উত্তম নামসমূহ রয়েছে। অতএব তোমরা তাকে এসব নামের মাধ্যমে ডাক। আর তাদেরকে বর্জন কর, যারা তার নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে (বিকৃতি ঘটিয়ে)। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল অবশ্যই পাবে। (সূরা আ`রাফ : আয়াত ১৮০)
গ. বলুন, আল্লাহ একক। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কারও ঔরষে জন্মও নেননি। তার সমতুল্য কেউ নেই। (সূরা ইখলাস)
তার মতো কোনো কিছু নেই আর তিনি সর্বস্রোতা সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শূরা : আয়াত ১১)
ঘ. আর তোমাদের ইলাহ্ কেবল একজনই ইলাহ্। তিনি ছাড়া মহা করুণাময় দয়ালূ কেউ নেই। (সূরা বাক্বারা : আয়াত ১৬৩)।
ঙ. তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর ইবাদতে কাউকে শরিক কর না। (সূরা নিসা : আয়াত ৩৬)
চ. আমার নামাজ আমার কুরবানী আমার জীবন ও মৃত্যু সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল মুসলিম। (সূরা আনআ’ম : আয়াত ১৬২-১৬৩)

শিরকের প্রকার-
১. শিরকে আকবর (বড় শিরক)
২. শিরকে আসগার (ছোট শিরক)

শিরকে আকবর : সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা; যেমন- কাউকে ইবাদতমূলক আহ্বান করা; কাউকে আল্লাহর ন্যায় ভালবাসা, আল্লাহ ব্যতিত অন্যের নামে পশু জবাই বা কুরবানি করা, কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক জানা, ভবিষ্যতের অজানা অমঙ্গল দূরকারী সাব্যস্ত করা; সন্তান দারকারী হিসেবে মানা; ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতিকারী মানা, ভাগ্য সুপ্রশস্তকারী হিসেবে সাব্যস্ত করা। মূল কথা হচ্ছে উপরোক্ত বিষয়ে মুখ, অন্তর, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা আল্লাহর বিপেরীতে অন্য কাউকে বিশ্বাস করা সিজদাহ করাই হচ্ছে ইসলামের শিরক। এসবই শিরকে আকবরের অন্তর্ভূক্ত।

শিরকে আকবরের ভয়াবহ পরিণতি-
এ শিরক সম্পাদনকারী সম্পূর্ণরূপে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়। কারণ তা সরাসরি কুফরির নামান্তর। ফলে তার কোনো নেক আমল কাজে আসে না বরং সবই বিফলে যায়। শিরক মিশ্রিত কোনো নেক আমলই আল্লাহ তাআলা কুবল করেন না মহান আল্লাহ বলেন-

ক. আল্লাহ অবশ্যই তার সঙ্গে শিরকের গুনাহ ক্ষমা করবেন না। এ ছাড়া অন্যান্য যত গুনাহই হোক না কেন, তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করেছে সে তো এক বিরট মিথ্যা রচনা করেছে এবং কঠিন গুনাহের কাজ করেছে। (সূরা নিসা : আয়াত ৪৮)
খ. যদি তাঁরা (নবী রাসূলগণ) শিরক করতেন তবে অবশ্যই তাদের সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যেত। (সূরা আনআ’ম : আয়াত ৮৮)
গ. (হে নবি) আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি ওহি করা হয়েছে যে, যদি আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থাপন করেন, তাহলে আপনার সব আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। (সূরা যুমার : আয়াত ৬৫)
ঘ. যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার করল, আল্লাহ তার ওপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার পরিণতি হবে জাহান্নাম। এ সব যালিমদের কেউই সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়িদা : আয়াত ৭২)

২. শিরকে আসগার : শিরকে আকবর নয় এমন যে সব কর্মকে শরিয়তে সুস্পষ্ট প্রমাণ দ্বারা শিরক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে সেগুলোই শিরকে আসগার। শিরকে আসগর হলো এমন সব কথা বা কাজ বাহ্যিকভাবে গাইরুল্লাহকে আল্লাহ তা’আলার সঙ্গে সমান করে নেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, যদিও এই সমান করাটি প্রকৃতপক্ষে কর্তাব্যক্তির উদ্দেশ্য নয়।

উদাহরণ : কোনো ব্যক্তির এরূপ বলা-
ক. আমি আল্লাহ এবং আপনার উপর ভসরা করছি, আপনিই আমার একমাত্র ভরসা
খ. আল্লাহ এবং আপনি যা চান
গ. আল্লাহ আর আপনি যদি না থাকতেন তাহলে মহাবিপদ হয়ে যেত
ঘ. আমি আল্লাহর অনুগ্রহে এবং আপনার দোয়ায় ভাল আছি
ঙ. এই পোষা কুকুরটি বা বিড়ালটি না হলে আজ রাতে আমার বাড়িতে চোর ঢুকে পড়ত
চ. মাঝি বড় দক্ষ ছিল বিধায় আজ জীবন রক্ষা পেল
ছ. ড্রাইভারের দক্ষতায় বাসটি রক্ষা পেল
জ. যেমন সার দিয়েছি তেমন ফসল হয়েছে
পাশাপাশি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে কসম করা-
ক. মাটি হাতে নিয়ে কসম
খ. বাবা-মার নামে কসম
গ. সন্তান-সন্ততির নামে কসম
ঘ.নবী-রাসূলদের নামে কসম
ঙ. পরহেজগার ব্যক্তির নামে কসম
চ. পবিত্র স্থানের নামে কসম
ছ. খাবার ছুঁয়ে কসম বা কাউকে ছুঁয়ে কসমসহ যাবতীয় কসম।

দুনিয়াবি স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে, লোক দেখানো ভঙ্গিমায় ইবাদত-বন্দেগিসহ ইত্যাদি বিষয় শিরকে আসগরের অন্তর্ভূক্ত।

কখনও কখনও ব্যক্তির মানসিক অবস্থা ও উদ্দেশের প্রেক্ষিতে শিরকে আসগরগুলো শিরকে আকবরে পরিণত হতে পারে।

হাদিসের এসেছে-
ক. আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহ আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদেরকে এমন বিষয়ে সংবাদ দিব না, যে বিষয়টি আমার কাছে মাসীহ দাজ্জালের চাইতেও ভয়ংকর? সাহাবাগণ বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তা হচ্ছে গোপন শিরক। (এর উদাপহরণ হলো) একজন মানুষ দাঁড়িয়ে শুধু এ জন্যই তার নামাজকে খুব সুন্দরভাবে আদায় করে যে, কোনো মানুষ তার নামাজ দেখছে। (ইবনু মাজাহ)

খ. ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে কা’বা ঘরের শপথ করতে শুনে বললেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর শপথ করবে না। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে শপথ করে সে কুফরি করল বা শিরক করল। (তিরমিজি)

গ. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে জিনিস তোমার উপকারে আসবে তার দিকে ধাবিত হও এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও আর অক্ষমতা প্রকাশ কর না। যদি তোমার ওপর কোনো বিপদ এসে পড়ে তাহলে একথা বল না, ‘যদি আমি এ রকম করতাম, তাহলে অবশ্যই এমত হতো।’ বরং তুমি এ কথা বল, ‘আল্লাহ তক্বদিরে রেখেছেন এবং ইচ্ছা করেছেন তাই হয়েছে।’ কেননা ‘যদি’ কথাটি শয়তানের জন্য কুমন্ত্রণার পথ খুলে দেয়। (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)

ঘ. ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে কোনো বিষয়ে কথা বলার প্রসঙ্গে বলল, আল্লাহ এবং আপনি যা চান। লোকটি এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে নিলে?।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)

ঙ. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোনো কিছুকে অশুভ মনে করা শিরক। (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনু মাজাহ)

শিরকে আসগরের পরিণতি-
এ শিরক তার সম্পাদনকারীকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না। কিন্তু আমলকে ধংস করে দেয়। এর আমলকারী ব্যক্তি ফাসিক। তাই আল্লাহর প্রিয় বান্দা তথা তাওহিদে বিশ্বাসী প্রত্যেকের জন্য এই শিরক হিফাজত তথা বেঁচে থাকা অতিব জরুরি।

সুতরাং যারা শিরক করে তারা মূলত আল্লাহ তাআলার অসীম ক্ষমতা ও বড়ত্ব সম্পর্কে গাফেল। এবং মানুষ আল্লাহর কুরআন অধ্যয়ন থেকে বিরত থাকার কারণেই অগণিত অসংখ্য শিরকে আকবর ও আসগরের মতো গর্হিত কাজে লিপ্ত। অথচ এ কাজগুলোর সবই আল্লাহর সামনে তুচ্ছ, কর্মে চরম অক্ষম। বরং সমগ্র সৃষ্টির প্রতিটি মূহূর্ত মহান আল্লাহর দয়ার মখাপেক্ষী। আল্লাহ শিরককারীর কোনো আমল গ্রহণ করবেন না। তাই আমরা শিরকে আকবরসহ সমস্ত শিরক থেকে নিজেকে হেফাজত করতে আল্লাহর সাহায্য কামনা করি। মহান আল্লাহর রহমত চাই, বরকত চাই, কল্যাণের পথ লাভ করে চাই। আল্লাহ সকল মানুষকে কুরআন-হাদিস অধ্যয়নের মাধ্যমে তাকে চেনার-জানার এবং শিরক পরিত্যাগ করার তাওফিক দান করুন। সব ভাল কাজের প্রতিদান বহু বহু গুণ বাড়িয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সফল হওয়ার মদদ দান করুন। আমিন।

চাঁদপুর টাইমস ডটকমের সঙ্গে থাকুন। সুন্দর সুন্দর ইসলামী আলোচনা পড়ুন। কুরআন-হাদিস মোতাবেক আমলি জিন্দেগি যাপন করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।

 

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫

চাঁদপুর টাইমস ডট কমপ্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি