বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের শ্রদ্ধা ও স্মরণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের সামনে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলিতে লাল ইটে দাঁড়িয়ে আছে এই শহীদ মিনার।
এ স্থাপত্যকর্মে চিত্রিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি ও গৌরবগাঁথা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অর্জনকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে তৈরি এ মিনারের ভিত্তিমঞ্চের ব্যাস রাখা হয়েছে ৫২ ফুট। আর একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ স্মরণে ভিত্তিমঞ্চ থেকে উন্মুক্ত আকাশগামী তিনটি স্তম্ভের উচ্চতা ৭১ ফুট।
প্রত্যেক স্তম্ভের আবার রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। এর মধ্যে প্রথমটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি, দ্বিতীয়টি মাটি, মানুষ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও আন্দোলন-সংগ্রাম এবং তৃতীয়টি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুক্তি ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক। ঊর্ধ্বগামী এই স্তম্ভগুলো আমাদের স্বাধীন হতে শেখায়। বাধা ডিঙিয়ে অসীমকে জয় করার অনুপ্রেরণা যোগায়।
শহীদ মিনারের মূল বেদিতে ওঠার জন্য রয়েছে আটটি সিঁড়ি। এরও রয়েছে আলাদা কথা। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত নানান আন্দোলন-সংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত আটটি বছরকে নির্দেশ করে এই সিঁড়িগুলো। সেগুলো হলো- ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১।
পুরো শহীদ মিনারটি তৈরি হয়েছে লাল ইটে। এই লাল বাঙালির বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে বিসর্জন দেয়া রক্তের স্মৃতি বহন করে। মিনারের চারপাশ সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত হওয়ায় তা পাখির চোখে যেন এক টুকরো বাংলাদেশের পতাকার আকার ধারণ করে।
এই শহীদ মিনারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০০৪ সালের ৬ নভেম্বর। এরপর ২০০৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান। স্থাপত্যশৈলির অনন্য নিদর্শন এই শহীদ মিনারের নকশা করেছেন প্রখ্যাত স্থপতি রবিউল হোসাইন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাহাঙ্গীরনগরের সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে এই শহীদ মিনার। প্রতিবছর বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সকাল কিংবা সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আড্ডার সঙ্গী হয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ।
আবার বিভিন্ন প্রতিবাদ, আন্দোলনেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারের পাদদেশে জড়ো হন। এছাড়া রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে শহীদ মিনারের সৌন্দর্য। সবার মনে স্বাধীনতা ও বাঙালির চেতনার উদ্রেক করে এই মিনার।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আক্তারুজ্জামান সোহেল বলেন, শহীদ মিনার আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করিয়ে দেয়। জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে জানতে ও স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ব করে এই শহীদ মিনার। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনারের প্রয়োজন আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর কবির বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যে নির্মিত। এ ধরনের স্থাপনা ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণের জন্য প্রয়োজন। এটি বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করিয়ে দিতে এই শহীদ মিনারের তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, শহীদ মিনার আমাদের আলোকিত করার পাশাপাশি এটি এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব করার জায়গা। এছাড়া ভাষা শহীদদের স্মরণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক হল রয়েছে। শহীদদের বিশেষভাবে মনে রাখতে এগুলোর দরকার রয়েছে।
ঢাকা ব্যুরো চীফ,২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১