মৃত্যু শাশ্বত, মৃত্যুই পৃথিবীর অমোঘ রীতি; যা এড়ানো যায় না। তবে কিছু মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত-অসময়ে হয়ে যায়; যার ক্ষতি অপূরণীয়। ২০২০ সালে আমাদের চোখের সামনে এমন কিছু রাজনীতিবিদের মৃত্যু হয়েছে, যা ছিল অপ্রত্যাশিত ও অকল্পনীয়। এক পঞ্জিকাবর্ষে এতগুলো তারকা রাজনীতিকের চিরপ্রস্থান যে ক্ষতি বয়ে এনেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তাদের মধ্যে কারও কারও মৃত্যু অসুস্থতাজনিত কারণে, কয়েকজন মারা গেছেন বার্ধক্যজনিত কারণে; আর বাকিদের মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসে। বৈশ্বিক এই মহামারী ছোবল বসিয়েছে বাংলাদেশেও।
২০২০ সালে মারা গেছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ জাতীয় চার নেতার একজন এম মনসুর আলীর ছেলে সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। মারা গেছেন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ। প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সাহারা খাতুনও না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন এ বছরেই। সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মৃত্যু হয়েছে করোনায়। একই কারণে মৃত্যু হয়েছে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্লাটফরম হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফী কিছু দিন আগে মারা গেছেন।
একই পঞ্জিকাবর্ষে আরও কয়েকজন রাজনীতিবিদের জীবনাবসান হয়েছে। এই মৃত্যুগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনকে নাড়া দিয়েছে ব্যাপকভাবে। এনে দিয়েছে শোকাবহ পরিবেশ। যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
মোহাম্মদ নাসিম
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম টানা আট দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১৩ জুন বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নাসিমের মৃত্যুতে রাজনীতির একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের সমাপ্তি ঘটল।
মোহাম্মদ নাসিমের বাবা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে বিজয়ী হন। পিতার মতো রাজনীতিতে এসে সবার অন্তরে ঠাঁই করে নেন মোহাম্মদ নাসিমও। ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক হাতেখড়ি। এর পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগে প্রবেশ। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের যোদ্ধা। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মোহাম্মদ নাসিম। ওই সম্মেলনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পর ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে তিনি দলের প্রচার সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে মোহাম্মদ নাসিমকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। দায়িত্ব পালনে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। এ সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ ছিল একটি। ২০০২ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে তাকে কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। এর পর ২০১২ সালের সম্মেলনে তাকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর পর টানা তিন মেয়াদে তিনি এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করে আসছিলেন তিনি। রাজনীতির মাঠে যেমন সুবক্তা তেমনই একজন ঝানু সংসদ সদস্য হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ নাসিম।
শাহজাহান সিরাজ
স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগঠক ও স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক শাহজাহান সিরাজ ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ১৪ জুলাই মারা গেছেন।
ছাত্রলীগ, জাসদ ও পরে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া শাহজাহান সিরাজ মন্ত্রী হলেও ‘৭১ সালে উত্তাল মার্চে ছাত্রসমাজের পক্ষে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠকারী হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নাম লেখা থাকবে তার।
টাঙ্গাইলে জন্ম নেয়া শাহজাহান সিরাজ স্বাধীতার আগে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে ‘চার খলিফা’র একজন হিসেবে খ্যাত তিনি। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে জাসদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তার। এর পর জাসদের নানা ভাঙনের মধ্যে নিজে একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। গত শতকের ‘৯০-এর দশকে এসে বিএনপিতে যোগ দেন তিনি। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে তিনি বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর সময় দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
শাহজাহান সিরাজ ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ তিনি সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব প্রভৃতি ছাত্রনেতার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন আ স ম আবদুর রব। সেখান থেকেই পরবর্তী দিনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের পরিকল্পনা করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩ মার্চ ১৯৭১ পল্টন ময়দানে বিশাল এক ছাত্র জনসভায় বঙ্গবন্ধুর সামনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন শাহজাহান সিরাজ।
এর পর যুদ্ধ শুরু হলে তিনি সশস্ত্র যুদ্ধ চলাকালীন ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৬৪-৬৫ ও ১৯৬৬-৬৭ দুই মেয়াদে তিনি দুবার করটিয়া সা’দাত কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। একজন সক্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেন। এর পর তিনি ১৯৭০-৭২ মেয়াদে অবিভক্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন, যা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সহকারী সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শাহজাহান সিরাজ। পরে জাসদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাসদের মনোনয়নে তিনবার তিনি জাতীয় সংসদের টাঙ্গাইল-৪ কালিহাতী আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সাহারা খাতুন
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৯ জুলাই ৭৭ বছর বয়সে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
তৃণমূল থেকে লড়াই করে রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসা সাহারা খাতুন আইন পেশায় থেকেই আওয়ামী লীগে সক্রিয় ছিলেন। বিয়ে-সংসারের প্রথাগত পথে না গিয়ে তিনি নব্বইয়ের দশকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ দলের দুর্দিনে আজীবন মাঠে ছিলেন সক্রিয়।
ঢাকা-১৮ সংসদীয় আসন থেকে নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন সাহারা খাতুন।
সাহারা খাতুন ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ ঢাকার কুর্মিটোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুল আজিজ এবং মায়ের নাম টুরজান নেসা। সাহারা খাতুন বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন।
তিনি ঢাকা-১৮ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে মহাজোট ক্ষমতায় এলে প্রথমে তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। পরে দেয়া হয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
কামাল ইবনে ইউসুফ
করোনাভাইরাসে যে কয়জন রাজনীতিবিদ মারা গেছেন, তাদের মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ অন্যতম। ৯ ডিসেম্বর তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।
কামাল ইবনে ইউসুফ রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন। আমৃত্যু তিনি বিএনপি করে গেছেন।
১৯৪০ সালের ২৩ মে ফরিদপুরে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ। তার পিতামহ চৌধুরী মঈজউদ্দিন বিশ্বাস জমিদার ছিলেন। তার বাবা চৌধুরী ইউসুফ আলী (মোহন মিয়া) ছিলেন ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা।
১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৯ সালে দলটিতে যোগ দেন চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ। তিনি ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট ডেভেলপমেন্টে কাউন্সিলর (ডিডিসি) ছিলেন। ফরিদপুর-৩ আসন থেকে তিনি দ্বিতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদে ধানের শীষ প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৮১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার সরকারের স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী, ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং ২০০১ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
আল্লামা আহমদ শফী
দেশের বর্ষীয়ান আলেম ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, কওমি মাদ্রাসার সম্মিলিত শিক্ষা সংস্থা আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ ও কওমি শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি আল্লামা আহমদ শফী কয়েক দিন আগে মারা গেছেন। দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্লাটফরম হেফাজতের আমির ১৮ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন।
তার বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন।
আল্লামা শফী চট্টগ্রামের আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় ৩৪ বছর ধরে মুহতামিমের (মহাপরিচালক) দায়িত্ব পালন করছিলেন।
১৯৪০ সালে তিনি হাটহাজারীর দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় যান, সেখানে চার বছর লেখাপড়া করেন।
দেওবন্দে থাকাবস্থায় তিনি বহু ইসলামী পণ্ডিতের সান্নিধ্যে ইমান-আমলের ওপর মেহনত করেন। তাদের অন্যতম হলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা আওলাদে রাসুল মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমাদ মাদানী (রহ)।
আহমদ শফীর মেধা ও দক্ষতা দেখে ছাত্র অবস্থাতেই তাকে মাওলানা মাদানী (রহ.) খেলাফত প্রদান করেন।
উর্দু, ফার্সি, আরবি ভাষা ও সাহিত্যে সুদক্ষ পণ্ডিত আহমদ শফী ১৯৮৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসায় মহাপরিচালক পদে যোগ দেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর মাদ্রাসার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়।
অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন বিভাগ খোলা ও শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নসহ শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণে নানামুখী পদক্ষেপ নেন।
আহমদ শফী বাংলায় ১৩ ও উদুর্তে ৯টি বইয়ের রচয়িতা। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- (বাংলা) ‘হক ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব’, ‘ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা’, ‘ইসলাম ও রাজনীতি’, ‘সত্যের দিকে করুন আহ্বান’ ‘সুন্নাত ও বিদআতের সঠিক পরিচয়’, (উর্দু) ‘ফয়জুল জারি (সহিহ বুখারির ব্যাখ্যা)’, ‘আল-বায়ানুল ফাসিল বাইয়ানুল হক্ব ওয়াল বাতিল’, ‘ইসলাম ও ছিয়াছাত’, ‘ইজহারে হাকিকাত’।
ইসমাত আরা সাদেক
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক ২১ জানুয়ারি পৃথিবী ছেড়ে যান। যশোর-৬ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। ওই আসনে একসময় তার স্বামী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এএইচএসকে সাদেক সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছিল ইসমাত আরাকে। পরে তাকে করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী।
শেখ আবদুল্লাহ
ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মো. আবদুল্লাহ ১৩ জুন করোনায় মারা গেছেন। শেখ আবদুল্লাহ ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
তিনি ১৯৪৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার মধুমতী নদীর তীরবর্তী কেকানিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ধার্মিক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ মতিউর রহমান ও মা রাবেয়া খাতুন। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।
শেখ আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগে ত্যাগী নেতা হিসেবেই সমধিক পরিচিত। রাজনীতিতে তার ত্যাগ বেশ আলোচিত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্ট মুজিব বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। কাউন্সিলের মাধ্যমে তিনি গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দীর্ঘদিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ধর্মবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
গোপালগঞ্জ-৩ (টুঙ্গিপাড়া-কোটালীপাড়া) আসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদীয় প্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে ছাত্রজীবনেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন আবদুল্লাহ। খুলনার আযম খান কমার্স কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচিত এই ভিপি ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
রহমত আলী
বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট রহমত আলী ৭৫ বছর বয়সে ১৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রহমত আলী গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর-ভাওয়ালগড়-পিরুজালী-মির্জাপুর) আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০১ সালের জুলাই পর্যন্ত তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। তার মেয়ে রুমানা আলী টুসী একাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি।
বদরউদ্দিন আহমদ কামরান
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বদরউদ্দিন আহমদ কামরান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৫ জুন মারা যান। ২০০২ সালে সিলেট পৌরসভা সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর ২০০৩ সালে প্রথম নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন কামরান।
১৯৮৯ সাল থেকে সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০০২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন কামরান। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদ পান।
শওকত আলী
জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শওকত আলী ৮৪ বছর বয়সে গত ১৬ নভেম্বর মারা যান।
পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয়েছিল, তাতে শওকত আলীকে ২৬ নম্বর আসামি করা হয়।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদে দায়িত্ব পালন করা শওকত আলী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়া হন এবং শরীয়তপুর-২ আসন থেকে ছয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
নূর হোসাইন কাসেমী
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা নূর হোসাইন কাসেমী ৭৫ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৩ ডিসেম্বর মারা যান।
১৯৪৫ সালের ১০ জানুয়ারি জন্ম নেয়া নূর হোসাইন কাসেমী জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব, বেফাকের সহসভাপতি ও আল-হাইয়া বোর্ডেরও কো-চেয়ারম্যান ছিলেন।
হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এ সংগঠনের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত ১৫ নভেম্বর নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি হলে সেখানে তাকে মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়।
মকবুল হোসেন
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৪ মে মারা যান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ঢাকার সাবেক সংসদ সদস্য হাজি মকবুল হোসেন।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুর আসনের সংসদ সদস্য মকবুল আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদে সদস্য ছিলেন।
আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন ৭৩ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ডিসেম্বর মারা যান।
তিনি পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) আসন থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালের সরকারে বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আ খ ম জাহাঙ্গীর ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮১-৮৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
শফিউল বারী বাবু
স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিউল বারী বাবু কয়েক দিন আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
শফিউল বারী বাবু ছাত্রজীবন থেকেই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আমৃত্যু সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
ইসরাফিল আলম
করোনাভাইরাস সংক্রমণ মুক্ত হওয়ার পর ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে ২৭ জুলাই মারা যান নওগাঁ-৬ আসনের সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম। তার বয়স হয়েছিল ৫৪ বছর। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ইসরাফিল। সেই থেকে টানা তিন বার এমপি হন তিনি।
ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী
২০২০ সালের দ্বিতীয় দিনেই রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রথম শোকের খবর আসে সাবেক সংসদ সদস্য ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পির আকস্মিক মৃত্যুতে। নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চার দিন পর ২ জানুয়ারি তার মৃত্যু ঘটে। পরে নমুনা পরীক্ষায় তার সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণের বিষয়টি ধরা পড়ে।
পেশায় আইনজীবী বাপ্পির বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর। যুব মহিলা লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর নবম ও দশম সংসদে সংরক্ষিত আসনের সদস্য ছিলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর বাপ্পি এক সময় সুপ্রিম কোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বও পালন করেন।
হায়দার আনোয়ার খান জুনো
কমিউনিস্ট নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আনোয়ার খান জুনো ২৯ অক্টোবর হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
কমিউনিস্ট নেতা হায়দার আকবর খান রণোর ছোট ভাই জুনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স করলেও বাম ধারা রাজনীতিকেই তিনি পেশা হিসেবে নেন। ষাটের দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া জুনো ছিলেন চীনপন্থী শিবিরে। ১৯৭০ সালে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হলে তিনি এর সভাপতির দায়িত্ব নেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন জুনো।
ঢাকা ব্যুরো চীফ,৩১ ডিসেম্বর ২০২০