করোনা সংক্রমণের মধ্যেও নাগরিক সেবা অব্যাহত রেখেছেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে তারা ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না। পৌরসভার সিংহ ভাগ কর্মীদের ৩ থেকে ১১ মাস পর্যন্ত বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে। নাগরিক উন্নয়ন সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এছাড়াও পৌরসভার কাউন্সিলরদের গত কয়েক মাসের সম্মানি ভাতার টাকাও বকেয়া খাতায় জমা পড়েছে।
এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পৌরসভার রাজস্ব আদায়ে ধস ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অপরিকল্পিতভাবে মাস্টাররোলে লোকনিয়োগ দেওয়াসহ পৌরসভার আয়ের উৎস না থাকায় এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে পৌরসভার কর্তাব্যক্তিদের খামখেয়ালীপনা ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন পৌরসভার নাগরিকরা।
জানা যায়, ২০১৫ সালে পৌরসভার বর্তমান পরিষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজনৈতিক বিবেচনায় মাস্টারারোলে ৩০ জনের বেশি লোক নিয়োগ করেন আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা প্রতীকে বিজয়ী মেয়র মো. মাহফুজুল হক। প্রতিমাসে যাদের ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকার বেশি বেতন-ভাতা দিতে হয়। মাস্টার রোলে নিয়োগকৃত এসকল কর্মীদের মেয়রের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে উপস্থিতি ছাড়া তেমন কোন কাজ নেই বলে অভিযোগ পৌর নাগরিকদের।
পৌর সভাসূত্রে জানা যায়, সাবেক মেয়র মঞ্জিল হোসেন দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলমান ১ মাসের বেতন ভাতা বকেয়া রেখে গেলেও বতর্মান পরিষদের দায়িত্ব পালনকালে বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় ৩ থেকে ১১ মাসের বেতন ভাতা বকেয়া রয়েছে।
এছাড়াও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডে গত ৫ বছরের পুরো টাকাই বকেয়া পড়ে আছে। বেতন ভাতা ও প্রভিডেন্ট ফান্ড মিলিয়ে বকেয়া পড়েছে কয়েক কোটি টাকা। এতে করে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন তারা।
তবে পৌরসভা সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ফরিদগঞ্জ পৌরসভায় স্থায়ী ২৫ জন ও মাস্টাররোলের ৪১ জন মিলিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৬৬ জন। এতে জনপ্রতিনিধিদের সম্মানী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাবদ মাসে প্রায় ১১ লাখ টাকা করে বছরে প্রয়োজন পড়ে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার বেশি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রæতি রক্ষা করতে গিয়ে পৌরসভা রাজস্ব আয় দিয়ে বেতন ভাতা, সম্মানী পরিশোধ করে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন জনপ্রতিনিধিরা। যত দিন যাচ্ছে, তত বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে।
এ বিষয়ে ফরিদগঞ্জ পৌরসভার ইঞ্জিনিয়ার মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমার গত ৮ মাসের প্রায় ৪ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা বেতন বকেয়া রয়েছে। এছাড়া গত ৫ বছরে ভবিষ্যৎ ও আনুতোসিক তহবিলের ২৫ লক্ষ টাকাও ব্যাংকে জমা দেয়নি পৌর কর্তৃপক্ষ’।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাবেক মেয়র মঞ্জিল হোসেন’র সময় আমাদের মাত্র এক মাসের বেতন বকেয়া ছিল। কি কারনে ব্যাংকে বকেয়া বেতন ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা জমা হয়নি এ বিষয়ে ক্যাশিয়ার ও মেয়র ভালো বলতে পারবেন।
৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী হাবিব বলেন, ‘আমার ৯ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। অসুস্থ থাকার কারণে বেতনের বিষয়টি একাধিকবার মেয়র, সচিব ও ক্যাশিয়ারকে বলেও কোন ধরনরে প্রতিকার পাইনি।’
কার্য-সহকারী মো.শরিফ হোসেন বলেন,‘আমার ৯ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে এবং ভবিষ্যৎ ও আনুতোসিক তহবিলের টাকা এযাবৎ ব্যাংকে জমা হয়নি।’ এছাড়া পৌরসভার নকশাকারক আল-আমিনের ৮ মাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. শাহাবুদ্দিনের ৬ মাস, রোলার চালক মুরাদ হাছানের ৮ মাস, মাঠ কর্মী রাশেদ হোসেনের ৭ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে।
এদিকে পৌরসভার ক্যাশিয়ার গিয়াস উদ্দিন জানান, ‘কাউন্সিলর যারা বিদ্রোহ করেছিলো তাদের বকেয়া ৩৩ মাসের সম্মানি ভাতার মধ্যে ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো.হারুনুর রশিদকে ৫০ হাজার, ৫নং ওয়ার্ডের জামাল হোসেনকে ৫০ হাজার, ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. খলিলুর রহমানকে ১ লক্ষ, ৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো.মজিবুর রহমানকে ১ লক্ষ ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য ফাতেমা বেগমকে ৫০ হাজার টাকা বকেয়া বাতা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া পৌরসভার কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রতিমাসে বেতন ভাতা বাবদ প্রায় ১১ লক্ষ টাকা প্রয়োজন হয় বলে জানান তিনি।’
পৌরসভার সচিব মো. খোরশেদ আলম জানান, ‘আমার গত ৩ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে।’ কি কারণে পৌরসভার কর্মচারীদের বেতন বকেয়া পড়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারবোনা। যা জানার আপনি মেয়র ও ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে জেনে নেন।’
এ বিষয়ে মেয়র মাহফুজুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান,‘আমি মেয়র হওয়ার পূর্বে এ পৌরসভাটি ‘গ’ শ্রেণিতে ছিল। আমি মেয়র হওয়ার পর পৌরসভাকে ‘খ’ শ্রেণিতে রূপান্তরিত করেছি। সাবেক মেয়র থাকা অবস্থায় পৌরসভার জনবল কম ছিল এবং পৌরসভার রাজস্ব বেশি ছিল। আমি মেয়র হওয়ার পর থেকে পৌর এলাকায় সারাদেশের ন্যায় সম্পত্তি বিক্রি ৭০ ভাগ কমে যাওয়ায় পৌরসভার কর্মচারীদের বেতন ঠিকমত দিতে পারিনি।’
বকেয়া বেতনের বিষয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন এ নিউজ বাদ দেন, পৌরসভার উন্নয়ন নিয়ে নিউজ করেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রী মো.তাজুল ইসলাম জানান, ‘আইন অনুযায়ী পৌরসভা গুলো তাদের আয় থেকে ব্যয় নির্বাহ করবে। এখন তারা আয় করতে পারছেন না, তাই ব্যয় নির্বাহ হচ্ছে না।’
এদিকে স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র জানায়, পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা নিয়ে বিদ্যমান সমস্যা এবং এর সমাধানের বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো.মাহবুব হোসেনকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত কমিটি পৌরসভার আয় বাড়ানো সাপেক্ষে বেতন দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
কারণ, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন অনুযায়ী পৌরসভাগুলোকে নিজস্ব আয় দিয়ে চলতে হবে। সরকারের আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই বলেও কমিটি তাদের মতামত জানিয়েছে।
প্রতিবেদক:শিমুল হাছান,৬ ডিসেম্বর ২০২০
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur