জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার তথ্য সমন্বয় করে সরকার ‘ইউনিক আইডি’ কার্ড প্রদানের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে থেকে একটি কর্তৃপক্ষের আওতায় গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীনে পরিচালিত হবে।
বিদ্যমান বাস্তবতায় উন্নত বিশ্বের চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় এ সংক্রান্ত মতামত প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ৬ কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ৫ নভেম্বর রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
এর আগে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিস্তারিত লিখিত মতামত চাওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রিপোর্ট প্রস্তুত করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসন ও বিধি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব সোলতান আহমদকে প্রধান করে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগের সচিব মো. কামাল হোসেন রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ গঠন নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করছি না। তবে এতটুকু বলতে পারি সিআরভিএস (সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স) নিয়ে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি। যেখানে বেশ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।’
এদিকে এ বিষয়ে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বিধি ও সেবা অধিশাখা এবং আইন অধিশাখার যুগ্মসচিব শফিউল আজিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু দ্রুত উন্নতির দিকে যাচ্ছে; তাই জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নাগরিকের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদির বিষয়ে উন্নত বিশ্বের মডেল অনুসরণ করার ওপর সরকার জোর দিচ্ছে।
এ লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১০ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সিআরভিএস নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অনেক দূর এগিয়েছে। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে তারা আলোচ্য বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজটি এক সময় প্রতিষ্ঠানিক রূপ পাবে বলে তিনি মনে করেন। এজন্য যথাসময়ে বিধিগত একটি সংস্থা কিংবা কর্তৃপক্ষ গঠিত হতে পারে।
যে সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক রিপোর্টিং অথোরিটি হবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে তাদের কমিটির প্রস্তুতকৃত মতামত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখানে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়ে সম্মতি দিলে পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এজন্য বিদ্যমান সংশ্লিষ্ট আইন, নীতি ও বিধি সংশোধন করতে হবে।
বর্তমানে ভোটার তালিকা আইন-২০০৯ এর ৬নং আইন এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০১০ এর অধীনে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রকাশ ছাড়াও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা, পরিচয়পত্র প্রস্তুত, বিতরণ ও রক্ষণাবেক্ষণসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ করছে নির্বাচন কমিশন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ সংক্রান্ত বিশদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন তথ্যভাণ্ডার নাগরিকদের পরিচয়পত্র প্রস্তুতসহ ১২৭টি চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে।
২০১৪ সাল পর্যন্ত ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত নাগরিদের লেমিনেটিং কার্ড প্রদান করা হলেও বর্তমানে স্মাটকার্ড প্রদান করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে ২২ ধরনের সেবা প্রদান করা হয়।
যার বেশিরভাগ নির্বাহী ধরনের কাজ। ভবিষ্যতে এর কর্মপরিধি আরও বাড়বে। তাই এ কাজকে আরও যুগোপযোগী, নিরাপদ, জনবান্ধব ও টেকসই করতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ গঠন করা প্রয়োজন।
এতে এক স্থানে বলা হয়, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধনের বিষয়টি সর্বজনীন, পক্ষান্তরে ভোটার তালিকার বিষয়টি শুধু ভোটার হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য ও নির্বাচনের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়।
সেক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রমের বিষয়টি সরকারের অধীনে উপযুক্ত কোনো সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বতন্ত্রভাবে সম্পন্ন হওয়া অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। অপরদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের কার্যপরিধির মধ্যে ‘সিটিজেনশিপ’ উল্লেখ রয়েছে।
কিন্তু জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন, পরিচয়পত্র প্রদান ও এর ব্যবহার নাগরিক সুবিধার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করার বিষয়টি শুধু সিটিজেনশিপ কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যেমন- জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, তালাক ইত্যাদি বিষয় সমন্বয়ে ইউনিক আইডি প্রদানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যা সংক্ষেপে সিআরভিএস বা সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, একটি একক আইডি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককেই চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিবন্ধিত করা এবং তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পরিসংখ্যান তৈরি করার নিয়মিত প্রশাসনিক প্রক্রিয়া হল সিআরভিএস।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়িত কার্যক্রমে দ্বৈততা, অসামঞ্জস্য এবং কখনও কখনও বৈপরীত্য পরিহারের লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক এনপিআর বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার প্রণয়নের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সাল থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটি সমন্বিত ও কার্যকর সিআরভিএস ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করছে।
এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জন্ম, মৃত্যুর কারণ, বিবাহ, তালাক এবং দত্তক- এ ছয়টি বিষয় সিআরভিএসের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশে সিআরভিএস বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উল্লিখিত ছয়টি বিষয়সহ জনগণের স্থানান্তর এবং শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি সমন্বিত সেবা প্রদান ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
এজন্য বাংলাদেশে বিদ্যমান বিভিন্ন আইডি ব্যবস্থা যথা জন্ম নিবন্ধন, শিক্ষা ব্যবস্থায় স্টুডেন্ট আইডি, জাতীয় পরিচয়পত্র, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাসহ সব আইডির সমন্বয়ে একক বা ইউনিক আইডি প্রদানের প্রাথমিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বিদ্যমান আইন, বিধি-বিধান ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, একই ধরনের পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত সিভিল রেজিস্ট্রেশনের কার্যক্রম বিভিন্ন দফতরে ন্যস্ত।
যেমন- নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্র সম্পর্কিত কার্যক্রম, স্থানীয় সরকার বিভাগ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সম্পর্কিত কার্যক্রম এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সিভিল রেজিস্ট্রেশনের অংশ হিসেবে এসব কাজ কার্যক্রম সমন্বয় করছে।
ফলে প্রতিটি দফতর-সংস্থা কর্তৃক বারবার একই তথ্য সংগ্রহ করে সময় এবং সরকারি অর্থের অপচয় না করে সিআরভিএস সংক্রান্ত সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ‘ইউনিক আইডি’ প্রদান করলে তা রোধ করা সম্ভব।
বার্তা কক্ষ,২৩ নভেম্বর ২০২০