পেঁয়াজ ও চালের পর অসাধু ব্যবসায়ীরা এবার আলুর দাম নিয়ে নৈরাজ্য চালাচ্ছে। সরকারের দু’দফা মূল্য নির্ধারণেও সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
বাজার স্থিতিশীল রাখতে ৭ সেপ্টেম্বর খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ৩০ টাকায় বেঁধে দিয়ে তা কার্যকর করতে পারেনি সরকার। পরে মঙ্গলবার দ্বিতীয় দফায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতি কেজি ৩৫ টাকা নির্ধারণ করলেও সবজিটির দাম ভোক্তা সহনীয় করা যায়নি।
সরকারের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিত্যপণ্যটি বুধবার খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। পাশাপাশি পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি আলুর মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণের পরও রাজধানীর পাইকারি আড়ত কারওয়ান বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা।
এদিন সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে বেশি দরে বিক্রি করতে রাজধানীর পাইকারি আড়তগুলো থেকে আলু সরিয়ে বিক্রি বন্ধ রেখেছেন পাইকাররা। এছাড়া খুচরা বাজারে অন্যান্য সবজির সঙ্গে আলুর পসরা না সাজিয়ে লুকিয়ে বেশি দরেই বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত আলু থাকার পরও ব্যবসায়ীরা পণ্যটির কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দরে বিক্রির আশায় জনগণকে এক প্রকার জিম্মি করে রেখেছে।
সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি আলুর আড়তে গিয়ে সরবরাহ দেখা যায়নি। যেসব আড়তে আলু আছে তারা সরকার নির্ধারিত দাম (প্রতি কেজি ৩০ টাকা) অমান্য করে ৪২-৪৫ টাকায় বিক্রি করেছেন। একপর্যায়ে আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়ে বস্তা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এ বাজারে আলু কিনতে আসা আক্কেল আলী বলেন, পাইকারি আড়তে কোনো আলু নেই। এটা কি ধরনের কথা? পাইকাররা সব এক হয়ে আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু সরকারের বাজার তদারকি সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
কারওয়ান বাজারের এক পাইকার বলেন, সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও আড়তে যে আলু আছে তা বেশি দাম দিয়ে দু-তিন দিন আগের আনা। তাই বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। কম দামে বিক্রি করতে পারব না, এজন্য আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি।
অন্যদিকে বেলা ১১টার দিকে খুচরা পর্যায়ে হাতিরপুল কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অনেক সবজির দোকানে আলুর পসরা নেই। সাংবাদিক পরিচয় না দিয়ে এক বিক্রেতার কাছে আলু আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলু সাজানো নেই। ঝুড়ির ভেতরে আছে। কত কেজি লাগবে বলেন?
দাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৪৮ টাকা কেজি। সরকার নির্ধারিত ৩৫ টাকা দিতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই সরকারের দোহাই দেয়। আলু এনে যদি লাভ না করি তাহলে কিভাবে হবে।
কৃষি বিপণন অধিদফতর সূত্রে বলছে, দেশে গত মৌসুমে প্রায় ১ দশমিক ৯ কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। বছরে মোট আলুর চাহিদা প্রায় ৭৭ দশমিক ৯ লাখ টন। অর্থাৎ প্রায় ৩১ দশমিক ৯১ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত আছে। সামান্য পরিমাণ রফতানি হলেও ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই। তারপরও দাম বাড়ানো হয়েছে।
অ্যাগ্রিকালচার রিপোর্টার্স ফোরাম (এআরএফ) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে যোগ দিয়ে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, বাস্তবতা বিবেচনা করে আমরা আরও পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করে দিলাম। কিন্তু আলুর দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এটা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ব্যবসায়ী, আড়তদারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা মুনাফা করেন, মুনাফা করার জন্যই ব্যবসা করছেন। কিন্তু এ সুযোগে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার চিন্তা করবেন না। মানুষের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে আপনাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, আপনারা সরকারের নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করুন। দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে দু-এক দিনের মধ্যে বাজার মনিটরিং জোরদার করা হবে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী।
এদিকে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বুধবার থেকে রাজধানীর ৮০টি পয়েন্টে ২৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছে। এতে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই কেজি আলু কিনতে পারছেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজধানীর খামার বাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কম মূল্যে আলু কিনতে টিসিবির বিক্রয় কেন্দ্র সব শ্রেণির ক্রেতার উপচে পড়া ভিড়। মহিলা ও পুরুষ দুটি লাইনে আলুসহ পেঁয়াজ, মসুর ডাল, চিনি বিক্রি করা হয়েছে।
এখানে আলু কিনতে আসা মকবুল হোসেন বলেন, বাজারে আলু ও পেঁয়াজের অনেক দাম। তাই লাইনে দাঁড়িয়ে কম দামে এ দুটি পণ্য কিনছি। তাতে একটু কষ্ট হলেও কিছু টাকা সাশ্রয় হয়েছে। তবে আলু দুই কেজির বদলে কমপক্ষে তিন বা চার কেজি বিক্রি করলে ভালো হতো। গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে বুধবার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা ও মহাসচিব মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা বলেন, পেঁয়াজ-আলুসহ নিত্যপন্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ সরকার দেশের সাধারণ মানুষকে কঠিন বিপাকে ঠেলে দিচ্ছে।
বাজারের অবস্থা থেকে প্রমাণিত হয় সরকার নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জনগণ সরকারের কথার ফুলঝুরি নয়, কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চান। চলতি মাসের শুরু থেকে আলুর বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা যায়। ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৫০-৫৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পরে ৭ সেপ্টেম্বর হিমাগার, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম বেঁধে দিয়েছিল সরকার। সেখানে খুচরা পর্যায়ে ৩০ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে ২৫ এবং হিমাগার পর্যায়ে ২৩ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল।
কিন্তু ব্যবসায়ীরা এ দামে আলু বিক্রি করেনি। ব্যবসায়ীরা অজুহাত দেখায় এ দরে বিক্রি করলে তাদের লোকসান গুনতে হবে। তার প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মঙ্গলবার আবারও বৈঠকে বসে কৃষি বিপণন অধিদফতর। সেখানে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ৩৫ টাকা, কোল্ড স্টোরেজ বা হিমাগার পর্যায়ে ২৭ টাকা এবং পাইকারিতে ৩০ টাকা বেঁধে দিয়ে দাম পুনর্নির্ধারণ করে দিয়েছে অধিদফতর। নতুন করে দাম নির্ধারণ করা হলেও এ দাম বাজার পর্যায়ে উপেক্ষিত।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হচ্ছে না। নগরীতে খুচরা বাজারগুলোতে আলু বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৫-৫০ টাকা। কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা দাম বেশি নেয়ায় বাজারেও দাম চড়া বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে না বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা। যদিও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, বেশি দামে আলু বিক্রি করলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রংপুর ব্যুরো জানায়, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলুর দর ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও রংপুর অঞ্চলে মানভেদে ৩৮ থেকে ৪৬ টাকা দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। আর বেশি দামে বিক্রির কারণ জানতে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছেন খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা। পাইকাররা জানান, আগে ৫০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করেছি। এখন ৪৫ টাকা করেছি। সরকার ৩০ টাকা করে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের কিনতে হচ্ছে ৪০ টাকা করে। তাই সরকারের বেঁধে দেয়া দামে বিক্রি সম্ভব নয়।
সিরাজদিখান (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বাড়তি দামে বিক্রি হওয়া আলুর দাম নতুন করে আরও বেড়েছে। উপজেলার হাটবাজারে আলু প্রতি কেজি ৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। মাসের ব্যবধানে সবজিটির দাম ৫০ শতাংশের উপর এবং বছরের ব্যবধানে প্রায় ১০০ শতাংশ বেড়েছে।
বার্তা কক্ষ,২২ অক্টোবর ২০২০