আজ বিশ্ব খাদ্য দিবস ১৬ অক্টোবর। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য দিবস সংস্থার সাথে মিল রেখে এ বছরের মুজিববর্ষে প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়েছে। ‘ সবাইকে নিয়ে একসাথে বিকশিত হোন, শরীরের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন, আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ ’-এ প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের খাদ্য বিভাগ এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন করছে ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা গণভবন থেকে সকাল ১০ টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিশ্ব খাদ্য দিবসের উদ্বোধন করবেন। চাঁদপুর জেলা প্রশাসন, চাঁদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত চাঁদপুরে এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ।
বেলা ৩টায় চাঁদপুর জেলা প্রমাসক সম্মেলন কক্ষের আলোচনা সভায় এতে সভাপতিত্ব করবেন চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক মো.আব্দুর রশীদ ও চাঁদপুরের খাদ্য বিভাগের খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুন্ডু , কৃষি ও খাদ্য বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতই এবার বাংলাদেশে বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হবে । জাতীয়,আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বিশ্ব খাদ্য দিবস প্রতি বছর পালিত হয়ে থাকে।
হাঙ্গেরীর বিজ্ঞানী ড.পল রোমানী জাতিসংঘে ১৯৭৯ সালে সর্বপ্রথম বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাধারণ সভায় খাদ্য দিবস পালনের প্রস্তাব করেন । তারপর ১৯৮১ সাল থেকে প্রতিবছর খাদ্য ও কৃষি সংস্থার জন্মদিন উপলক্ষে ‘ ১৬ অক্টোবর ’ বিশ্বব্যাপি পালিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে , বর্তমানে পৃথিবীর খাদ্য নিরাপত্তার অন্যত্তম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। ফলে সৃষ্ট জালবায়ূর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ,খরা ,ঘূর্ণিঝড়,জলোচ্ছ্বাস , সাইক্লোন , বন্যা ও করোনার মত বৈর্শ্বিক মহামারী প্রভৃতি আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবার হুমকির মুখে রয়েছে।
এক তথ্যে জানা যায়- পৃথিবীর ১০ থেকে ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি বিভিন্ন কারণে হ্রাস, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাভাব, জ্বালানি তেলের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধি , একদেশ অন্যদেশের প্রতি যুদ্ধের মুখোমুখি পরিস্থিতি ও এবারে করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপি খাদ্য নিরাপত্তাকে আরো ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে।
শিল্পকারখানা স্থাপন, নগরায়ন,নতুন নতুন রাস্তা ঘাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, নতুন ইটের তৈরি আবাসভূমি নির্মাণ বা পরিধি বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করায়ও প্রতিনিয়ত বিশ্বব্যাপি খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে ।
এক জরিপের তথ্যে জানা যায়-বিশ্বের প্রায় ১শ কোটির বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তা নেই। তারা দিন কাটায় অর্ধাহারে-অনাহারে। তাছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে মানুষকে আতংকিত করছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা সতর্ক করে দিয়েছে ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। তাদের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলানোর সংগতি সক্ষমতার বাইরেও চলে যাতে পারে । ১৯৭২ সালের লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে দেশের লোক সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ।
২০১০ সালে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিবেদনে বলা হয়- একজন মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে ২,২২২ ক্যালরি খাবার গ্রহণ করতে হয় । এর চেয়ে কম গ্রহণ করে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৬ কোটি ১ লাখ । ১ হাজার ৮শ ক্যালরির কম খাদ্য গ্রহণ করে এমন জনসংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। এমনকি ১ হাজার ৬ শ ক্যালরির কম গ্রহণ করতে পারে এমন চরম দারিদ্রের সংখ্যা ৩ কোটি ১০ লাখ ।
চাঁদপুর দেশের অন্যত্তম কৃষিভিত্তিক অঞ্চল। চাঁদপুরের জরবায়ূ কৃষি উৎপাদনে সহায়ক। মেঘনা, ডাকাতিয়া ,মেঘনা-ধনাগোদা ও পদ্মা নদী বিধৌত এ চাঁদপুর। চাঁদপুর জেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী। জেলার ৪ টি উপজেলার ২০ টি ইউনিয়ন নদীভাঙ্গনগ্রস্থ ,নদীবিধৌত ও নদীসিকস্তি।
এ ছাড়াও মেঘনার পশ্চিমতীরে রয়েছে ১১টি বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল ও বেশ কটি এলাকা। এ এলাকার প্রায় ৩ লাখ অধিবাসী সরাসরি কৃষিকাজের সাথে সম্পৃক্ত। ধান, গম, আলু,পাট, আখ, ভ’ট্টা, পেঁয়াজ,রসুন, তিল, মুগ-মুসারি, মিষ্টি আলু, সোয়াবিন ও বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি চাঁদপুর জেলার প্রধান ফসল।
চাঁদপুর সেচ প্রকল্প ও মেঘনা ধনাগোদা নামে দু টি সেচ প্রকল্প রয়েছে। চাঁদপুর জেলার চারটি উপজেলা যথা- চাঁদপুর সদর, হাইমচর, ফরিদগঞ্জ, মতলব উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ২৩ হাজার ৩ শ’৯০ হেক্টর জমি রয়েছে এ দুটোতে। জেলার মোট খাদ্যের প্রয়োজন ৪ লাখ ২২ হাজার ৯শ ৫৫ মে.টন।
প্রতি বছর গড়ে উৎপন্ন হয়ে থাকে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৩শ ২২ মে.টন। এক সময় খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রকট। চাঁদপুর জেলাকে ২৭৪ টি কৃষিব্লকে ভাগ করে সকল প্রকার প্রযুক্তি উপজেলাভিক্তিক প্রদান করা হয়ে থাকে। ফলে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমেই বর্তমানে খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৩ শ ২২ মে.টন।
চাঁদপুরে ১২ টি হিমাগার ও ১ টি বীজভান্ডার রয়েছ্।ে যাতে ৬০ হাজার মে. টন আলু সংরক্ষণ করা সম্ভব। বাকি আলু সংরক্ষণে আলুচাষীদের কৃত্রিম প্রযুক্তি দেয় কৃষিবিভাগ। চাঁদপুরের সব উপজেলাতে কম-বেশি হারে কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়ে থাকে। নৌ-পথ,সড়কপথ ও রেলপথ থাকায় যে কোনো কৃষিপণ্য চাঁদপুর থেকে যে কোনো জেলায় আমদানি-রফতানি করা সহজ।
মতলব ব্রিজ ,চাঁদপুর-রায়পুর ব্রিজ, চাঁদপুর পুরাণবাজার ব্রিজ ও হাজীগঞ্জ –রামগঞ্জ ব্রিজ , ফরিদগঞ্জ ,এমএ ওয়াদুদ ব্রিজ ইত্যাদি ব্রিজগুলো যোগাযোগের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে কাজ করছ্।ে সড়ক পথের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সকল উপজেলায় রয়েছে আধুনিক খাদ্যগুদাম।
দেশের খাদ্য বিভাগের গবেষণালদ্ধ জ্ঞান ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ, সরকারের প্রদত্ত কৃষির উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার , সেচ সুবিধা, সার ও বিদ্যুৎ ভর্তূকি, উন্নতমানের বীজ সরবরাহ,আধুনিক কৃষি সাজ-সরঞ্জামাদি সরবরাহ ও নগদ প্রণোদনার মাধ্যমে দিন দিন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় চাঁদপুর বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
বর্তমানে চাঁদপুরের কৃষক ও কৃষক পরিবারও নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে খুবই আগ্রহ্।ী জলবায়ূ পরিবর্তনে ফলে তাদের যথাসময়ে ও সঠিকভাবে প্রদর্শিত পথ দেখাতে পারলে খাদ্য ঝুঁকি এড়াতে সক্ষম হতে পারবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলার সকল উপজেলার কৃষি উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে আমরা আশাবাদী ।
লেখক : আবদুল গনি , সাবেক শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী , চাঁদপুর । ১৬ অক্টোবর , ২০২০ । ফোন: ০১৭১৮-২২১০৪৪