ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। কিন্তু পদ্মা-মেঘনায় মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসের তুলনায় এবার মৌসুমের দুই মাসে জেলেরা নদীতে ইলিশ পেয়েছেন এক–চতুর্থাংশেরও কম। এমন পরিস্থিতিতে জেলে ও ইলিশ খাতে বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন বন্যায় কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক নদীতে পতিত হওয়া ও পদ্মা-মেঘনার বুকে অসংখ্য চর জেগে ওঠার কারণে ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাই ইলিশ নিরাপদে বিচরণের জন্য নদীর পরিবর্তে গভীর সমুদ্র বেছে নিয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক আনিছুর রহমান বলেন, নদীভাঙন ও বন্যার কারণে প্রতিবছর পদ্মা ও মেঘনায় অসংখ্য চর সৃষ্টি হয়ে নদী ভরাট হচ্ছে। এতে পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখন নদী আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি দূষণ হচ্ছে। এ বছর দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় উত্তরের জনপদ থেকে নানা ধরনের বর্জ্য, কৃষিজমির কীটনাশক নদীতে পতিত হয়েছে। এসব কারণে নদীতে ইলিশ থাকার বা বিচরণের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। এ বছর পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ কম পাওয়ার অন্যতম কারণ এগুলো। নদীতে ইলিশ কম পাওয়া গেলেও সমুদ্রে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
গত দুই মাসে জেলেরা পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ পেয়েছে ২৩৩ মেট্রিক টন। সম্প্রতি গোসাইরহাটের চরজানপুর এলাকাফাইল ছবি
শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে শরীয়তপুরে ৫ হাজার ২৬৩ মেট্রিক টন ইলিশের উৎপাদন হয়েছিল। গত বছর মৌসুমের জুলাই-আগস্ট মাসে ১ হাজার ১৬ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করেন জেলেরা। আর এ বছর এ দুই মাসে জেলেরা পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ পেয়েছেন ২৩৩ মেট্রিক টন; যা গত বছরের তুলনায় ৭৭ শতাংশ কম।
শরীয়তপুর জেলার ওপর দিয়ে পদ্মা ও মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। ৫০ কিলোমিটার পদ্মা ও ২০ কিলোমিটার মেঘনা নদীর সীমানায় ২০ হাজার ৯৫১ জন জেলে ইলিশ আহরণের কাজে যুক্ত রয়েছেন।
ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সরকারের নানা ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে স্থানীয় প্রশাসন। নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা (৯ ইঞ্চির ছোট ইলিশ) শিকার নিষিদ্ধ। ছোট ইলিশ বেড়ে ওঠার জন্য ইলিশের অভয়াশ্রমে সব ধরনের জাল ফেলা নিষেধ থাকে মার্চ-এপ্রিলে। মা ইলিশকে নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়তে দেওয়ার জন্য অক্টোবরে ২২ দিন নদীতে সব ধরনের মাছ শিকার বন্ধ রাখে সরকার।
নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার পদ্মা ও মেঘনা নদীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে নদীতে ইলিশ না পেয়ে জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকে সারা দিন নদীতে থেকেও ইলিশ পাচ্ছেন না।
গোসাইরহাট উপজেলার চরজানপুর এলাকার জেলে বসির উদ্দিন বাছারের ইলিশ শিকার করার নৌকায় ছয়জন শ্রমিক। ইঞ্জিনচালিত নৌকার তেল, শ্রমিকদের বেতন বাবদ প্রতিদিন তাঁর ৭ হাজার টাকা খরচ। কিন্তু তিনি প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার টাকার মাছ পাচ্ছেন। গত দুই মাসে তাঁর ৩ লাখ টাকা ঋণ নিতে হয়েছে।
বসির উদ্দিন বাছার বলেন, ‘অন্যান্য বছর এমন সময় প্রতিদিন ৩০-৪০ হাজার টাকার ইলিশ পেতাম। মাছ পাব এমন আশায় দিন-রাত নদীতে থাকি। কিন্তু মাছের আর দেখা পাই না।’
ভেদরগঞ্জের তারাবুনিয়া এলাকার জেলে রাসেল সরদার বলেন, ‘আমাদের তিন প্রজন্ম পদ্মায় ইলিশ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। কখনো নদীতে মাছের এমন আকাল দেখিনি। বছরের অধিকাংশ সময় ইলিশ শিকারে বাধা থাকে। মৌসুমের যেটুকু সময় পাই তখন যদি ইলিশ না পাওয়া যায় তাহলে আমরা বাঁচব কীভাবে?’
গোসাইরহাট উপজেলার ঠান্ডার বাজার ইলিশ অবতরণ কেন্দ্রের আড়তমালিক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রতিবছর ইলিশ ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগ করি। জেলেদের অগ্রিম টাকা দিয়ে মাছ ক্রয় করি। এ বছরও ৮০ লাখ টাকা লগ্নি করেছি। নদীতে মাছ নেই, জেলেরা আমাদের টাকা কীভাবে দেবেন, তা নিয়ে দুই পক্ষই চিন্তায় আছি।’
শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুর রউফ বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অস্বাভাবিকভাবে নদীতে ইলিশ কমে গেছে। বন্যার কারণে কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক নদীতে পতিত হয়েছে। এর প্রভাবে নদীতে মাছ নেই। বন্যার পানির প্রবাহ কমে গেছে, এখনো মৌসুমের তিন মাস আছে। এ সময় ইলিশ পাওয়া গেলে জেলে ও ইলিশ ব্যবসায়ীরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।
বার্তা কক্ষ,৪ সেপেটম্বর ২০২০