এম এ আকিব :
ক’দিনের টানা বর্ষণে চাঁদপুর শহরজুড়ে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় পৌরসভার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়ন নিয়েও বর্তমানে সচেতন পৌরবাসীকে ভাবিয়ে তুলছে।
ভুক্তভুগী পৌরবাসী অনেকেরই দাবি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার এমন বেহালদশার অন্যতম কারণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা আবাসন। এর জন্য পৌর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন তারা।
একদিকে শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কসহ পানি নিষ্কাশনের জন্যে যেসব স্থানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজন সেখানে আদৌ এর কোনো ব্যবস্থা নেই।
অপরদিকে শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়ক, সরকারি কলেজ এলাকাসহ বেশকিছু জনবহুল আবাসিক এলাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ যেসব স্থানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা রয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় তা যৎসামান্য এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর।
তাই পৌরকর্তৃপক্ষ যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা করেছে তা অপরিকল্পিত, এমনটাই মনে করছেন সচেতন পৌরবাসী। যদিও গত ক’বছরে এ বিষয়ে ব্যাপক পরিকল্পনার কথা বিভিন্ন সময় জানিয়েছিলেন টানা দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র নাছির উদ্দিন আহম্মেদ।
তবে মেয়রের এসব পরিকল্পনা এ যাবতকাল কতোটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে চলমান জলাবদ্ধতার কারণে তা’ নিয়ে এখন পৌরবাসীর মনে নানা প্রশ্নের দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
ভুক্তভুগী পৌরবাসীর অনেকেই আবার বলছেন, বিগত ক’বছর কেবল শুনেছি মাস্টার প্ল্যানের কথা কিন্তু বাস্তবে যেনো তা’ আজ রূপকথার গল্পের মতোই মনে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী শামছুদ্দোহা চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘জলবদ্ধতার বিষয়টি মেয়র মহোদয় গুরুত্বের সাথে দেখছেন। আমরা এ ব্যাপারে সরেজমিনে গিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্যে পৌরসভার উপ-সহকারী প্রকৌশলী আশুতোষ দত্ত ও নুরুল আমিনসহ বেশ ক’জনকে দায়িত্ব দিয়েছি। তারা সরেজমিনে গিয়ে প্রতিবেদন দিলেই পৌর পরিষদ জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
এদিকে চাঁদপুর শহরে কী ধরনের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রয়োজন ও জলাবদ্ধতার কারণসমূহ এবং পানি নিষ্কাশনে এ শহরের উল্লেখযোগ্য সুবিধাদি উল্লেখ করে পৌর পরিকল্পনাবিদ সাজ্জাদ হোসেন চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘পানি নিষ্কাশনে ভৌগলিক কিছু সুবিধা চাঁদপুর শহরে রয়েছে। শহরের মাঝ দিয়ে ডাকাতিয়া নদী এবং পাশ দিয়ে মেঘনা নদী বহমানই তার অন্যতম কারণ। যা চাঁদপুরবাসীর জন্যে আশীর্বাদস্বরূপ। যেটি শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের অনেক উন্নত শহরেও নেই। প্রয়োজন শুধু আবাসিক, বাণিজ্যিক ও জনবসতিপূর্ণ এলাকাসমূহ থেকে পানি অপসারণের স্থানভেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।’
পৌরসভার নেয়া দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্ল্যান নিয়ে এ নগর পরিকল্পনাবিদ চাঁদপুর টাইমসকে আরো বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদী যে কোনো পরিকল্পনা হয় ২০-৫০ বছরের, তেমনি চাঁদপুর শহরের পানি নিষ্কাশনে দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্ল্যান রয়েছে। যা ২০১০ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত পৌর এলাকার প্রায় সাড়ে ২২ স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা নিয়ে করা হয়েছে।’
তিনি চাঁদপুর টাইমসকে আরেরা বলেন, ‘এ মাস্টার প্ল্যানের এরিয়ায় ২০৩০ সাল নাগাদ স্থান বিশেষে বাণিজ্যিক, আবাসিক ও জনবসতিপূর্ণ কোন এলাকায় কী ধরনের অবকাঠামো হতে পারে, সে ধারনা নিয়েই এ পরিকল্পনাটি নেয়া হয়েছে। যাতে পৌর এরিয়াকে কয়েকটি জোনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় ভাগ করে পার্শবর্তী ড্রেনেজ ব্যবস্থার সাথে সংযোগ স্থাপন করা হবে। যার ব্যাপ্তি প্রতিটি অলি-গলিতেই থাকবে। তবে এটি এখনো চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।’
তিনি চাঁদপুর টাইমসকে আরো জানান, ‘একদিনে তো আর এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, এটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। তাছাড়া বর্তমানে পিডিবির পরিকল্পনায় শহরের পুরাতন এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কারে বার্ষিক ব্যয় নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু নতুন এলাকায় যে হারে আবাসন বাড়বে সে হারে জলাবদ্ধতার আশংকাও বৃদ্ধি পাবে। তবে দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্ল্যানে পুরো পৌর এলাকার পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত পরিকল্পনা রয়েছে। সবমিলে অন্য শহর থেকে চাঁদপুর শহরের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা অনেক ভালো।’
এদিকে শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে পৌর পরিষদ, এ বিষয়ে জানতে চাইলে পৌর মেয়র নাছির উদ্দিন আহম্মেদ চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘চাঁদপুরে কোনো জলাবদ্ধতা নেই এটি হবারও নয়। কারণ দেশের যে কোনো শহরের তুলনায় চাঁদপুর শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা অত্যন্ত ভালো।’
দেশের বিভিন্ন শহরের কথা উল্লেখ করে মেয়র চাঁদপুর টাইমসকে আরো বলেন, ‘যেখানে দেশের বিভিন্ন জেলা ও সিটি শহরে সামান্য বৃষ্টিতেই পানিতে হাবুডুবু খায় মানুষ। সেখানে চাঁদপুরে গত ক’দিনে যে ভারী বর্ষণ হয়েছে তা সাম্প্রতিককালের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এমন অস্বাভাবিক বৃষ্টিতে চাঁদপুর শহর ডুবে থাকার কথা। কিন্তু সামান্য যে পানি আটকা পড়েছে তা হওয়ার কথা ছিলো না।’
এসময় তিনি কিছুটা দায় নিয়েই শহরের লেকেরপাড়, নাজিরপাড়াসহ বেশকিছু এলাকার নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘এসব এলাকার জলাশয়গুলোয় মাছচাষীরা পানি নামার পথগুলো বন্ধ করে রেখেছিলো বিধায় কিছুটা জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আমি নিজে আমার পরিষদের সদস্যদের সাথে নিয়ে জলাবদ্ধতার এসব কারণ খুঁজে বের করে সমাধানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নিয়েছি এবং বন্ধ খালগুলোর মুখগুলো খুলে দেয়া ও পানি অপসারণে নতুন করে পাইপ বসানো হয়েছে। এ নিয়ে এতো হইচই করার প্রয়োজন নেই।’
এদিকে অপরিকল্পিত আবাসন গড়ে ওঠায় শহরের খালসমূহের মুখগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টির জন্যে পৌর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন সচেতন পৌর নাগরিকদের অনেকেই।
এমন অভিযোগ সম্পর্কে চাঁদপুর টাইমস-এর পক্ষ থেকে জানতে চাইলে পৌর মেয়র সম্প্রতি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানের কথা স্মরণ করিয়ে পৌরবাসীর সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘সাধারণ উচ্ছেদ অভিযানটি করতে গিয়ে পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও স্বয়ং আমাকেই নামতে হয়েছে পুলিশের ভূমিকায়। সেখানে পৌরসভা এলাকায় বসবাসের জন্যে যারা বাড়ি নির্মাণ করছে, তাদের বাসাবাড়ির পানি নামার ব্যবস্থাটুকুও যদি তারা চিন্তা না করে অপরিকল্পিতভাবেই আবাসন গড়ে তোলে সেখানে স্বাভাবিকভাবে কিছুটা অসুবিধা তো হবেই।’
পৌরবাসীর সকল নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী মাস্টারপ্ল্যানের কথা উল্লেখ করে পৌর মেয়র চাঁদপুর টাইমসকে আরো বলেন, ‘আমরা যে বসে আছি তা কিন্তু নয়। আমরা পৌরবাসীর সকল নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদী মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়েছি, যার খসড়াকপি তৈরি হয়েছে। শুধুমাত্র অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছি। এটি বাস্তবায়ন করা হলে আগামী ২০/৫০ বছরেও শহরে আর কোনো বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হবে না। আমরা অচিরেই দীর্ঘমেয়াদী মাস্টারপ্ল্যানটির চিত্র জনসম্মুখ্যে উপস্থাপন করবো। তখন মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারনাটি আর থাকবে না। এখন প্রয়োজন পৌরবাসীর সচেতনতা।’
আপডেট : বাংলাদেশ সময় : ১৫ আষাঢ় ১৪২২ বঙ্গাব্দ, সোমবার ২৯ জুন ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ, ০৬:০৮ অপরাহ্ন
চাঁদপুর টাইমস : ডিএইচ/এমএএ/এমআরআর/২০১৫
চাঁদপুর টাইমস ডট কম–এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি