বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর এবারের বন্যাই সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। মঙ্গলবার জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স বা ওসিএইচএ তাদের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। একইসঙ্গে নিজের ওয়েবসাইটেও এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা।
এতে বলা হয়, আগামী মাসের আগে বাংলাদেশে বন্যার পানি কমতে শুরু করার সম্ভাবনা কম। ওসিএইচএ জানিয়েছে, বন্যায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৮টি জেলায় ২৪ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি ঘরবাড়ি হারিয়ে সরকারি বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ৫৬ হাজার মানুষ। এই দুর্যোগে এখন পর্যন্ত ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে আরো উল্লেখ করা হয় যে, বন্যার শুরু থেকে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ বসতবাড়ি প্লাবিত হয়েছে।
বাঁধ ও বাঁধের মতো সুরক্ষা অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বন্যা চলাকালীন তাদের মানবিক সহায়তার কথা তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ ও তার মানবিক অংশীদাররা জরুরি খাবার প্যাকেট, পানি পরিশোধন সুবিধা, স্বাস্থ্যবিধি, ডিগনিটি কিট এবং জরুরি আশ্রয়ের মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করছে। সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে সহায়তার জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাগুলোকে প্রাথমিকভাবে ৫২ লাখ ডলারের তহবিল দিয়েছে জাতিসংঘের কেন্দ্রীয় ইমার্জেন্সি রেসপন্স ফান্ড। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া এবং তার সঙ্গে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বন্যায় সহায়তা ও পুনরুদ্ধার চেষ্টা আরো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
ওদিকে সারা দেশ থেকে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে বন্যায় চরম দুর্ভোগ ও দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে। খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে বিভিন্ন স্থানে। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে চলছে বানভাসীদের আহাজারী।
স্টাফ রিপোর্টার,মানিকগঞ্জ থেকে জানান, বন্যায় ভাসছে মানিকগঞ্জে অধিকাংশ এলাকা। পদ্মা-যমুনা বেষ্ঠিত হরিরামপুর, দৌলতপুর, শিবালয়, ঘিওর উপজেলার সব ইউনিয়নের প্রত্যেকটা এলাকা হাবুডুবু খাচ্ছে বন্যার পানিতে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে মানিকগঞ্জ সদর ও সাটুরিয়া উপজেলা। এতে কম আয়ের মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র খাবার সংকট। সরকারিভাবে ত্রান সহায়তা যেটুকু বিরতন করা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলানায় খুবই নগন্য। তারপরও সে ত্রান বেশীরভাগ এলাকায় এখনো পৌছায়নি। ত্রানের জন্য হাহাকার সর্বত্রই।
হরিরাপুরের চরাঞ্চলের বানভাসী মানুষেরা প্রায় ২০ দিন ধরে পানির সাঙ্গে লড়াই করে চলেছে। অর্ধহারে অনাহারে কাটছে তাদের দিনকাল। মঙ্গলবার স্থানীয় সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম একটি ইউনিয়ন কাঞ্চনপুরে দেড়শ পরিবারকে ত্রান দিলেও চরাঞ্চলে পা এখনো রাখেনি কেউ। হরিরাপুর উপজেলার সলিমপুর চরের বাসিন্দা দিনমুজুর শাজাহার জানান, আজ কদিন ধরে খেয়ে না খেয়ে বন্যার পানির সঙ্গে হাবুডুবু খাচ্ছি। কেউ আসেনি ত্রান নিয়ে। জনপ্রতিনিধি তো দুরের কথা টাকা ওয়ালারাও কোন খোজ খবর রাখেছে না। অথচ আগের দিন গুলোতে বিত্তবানরা সব দুর্যোগে ত্রান দিতো । কিন্ত এবার কেউ আসছে না। ঘরে চাল ফুরিয়ে গেছে। খুবই কষ্ট হচ্ছে পরিবার নিয়ে।
আনজিরা বেগম জানান,স্বামী বেকার হয়ে পড়েছে। চার মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে খুব কষ্টে দিন চলছে। বিত্তবানরাও আসে না, জনপ্রতিনিধিরা খোজ নেয় না। এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে মরা ছাড়া কোন উপায় নেই। রহিমা বেগম জানালেন, স্বামী নেই। দেড় বছর আগে মারা গেছে। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে খুবই কষ্টে দিন চলছে, তার ওপর বন্যা। জনপ্রতিনিধিরা শুধু ভোটের সময় পা ধরেন। ভোট শেষ হয়ে গেলে আমাদের কেউ চিনেই না। এদের মতো চরাঞ্চলের প্রতিটি মানুষের কণ্ঠে এই সুর। তারা সবাই মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।
জানা গেছে, মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য এএম নাঈমুর রহমান দুর্জয় তার নির্বাচনী এলাকা যমুনা নদী বেষ্ঠিত শিবালয় ও দৌলতপুর উপজেলার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় নিজে উপস্থিত হয়ে খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন। বাচামারা, বাঘুটিয়া, চরকাটাারীসহ আরো কয়েকটি চরাঞ্চলসহ তার নির্বাচনী এলাকায় গেল কয়েক দিনে প্রায় ৩ হাজার বন্যার্ত অসহায় পরিবারের মাঝে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন। বলেছেন, এই দুর্যোগে তিনি সর্বক্ষনই তার এলাকার বানভাসী ও অসহায় মানুষের পাশে থেকে খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রাখবেন।
এছাড়া তিনি সরকারের পাশপাশি বিত্তবানদের এই দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়েছেন। এছাড়া পাশের উপজেলায় হরিরামপুরের পদ্মা বেষ্টিত চরাঞ্চলে কোন জনপ্রতিনিধির পা পড়েনি। এখনো সরকারি-বেসরকারি কোন খাদ্য সহায়তা পৌছায়নি সেসব এলাকায়। এর আগে যে কোন দুর্যোগে বিত্তবানদের ভুমিকা চোখে পড়ার মতো থাকলেও এবারের ভয়াবহ বন্যায় তা চোখে পড়ছে না।
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, দিন যাচ্ছে দুর্ভোগ বাড়ছে অচল হয়ে পড়েছে চিলমারী। দীর্ঘ বন্যার কবলে উপজেলা সদরসহ প্রায় শতাধিক গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে দুইলক্ষাধিক মানুষ। করোনার ভয় না কাটতেই বন্যা উপজেলাবাসীকে বিপাকে ফেলিয়েছে। দীর্ঘ বন্যার কবল থেকে চিলমারীকে রক্ষা করতে নেই কোন পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের। শিশু, বৃদ্ধা ও গৃহপালিত পশু পাখি নিয়ে অসহায় বানভাসীরা।
জানা গেছে, টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলা সদর রক্ষা বাঁধটি অরক্ষিত থাকায় ভাঙ্গা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে উপজেলা সদরসহ প্রায় শতাধিক গ্রাম তলিয়ে যায়। আবারো কমে যায় ব্রহ্মপুত্রের পানি কিন্তু সদরের পানি বের হওয়ায় একটি মাত্র পথ থাকায় দীর্ঘ বন্যার কবলে পড়েছে উপজেলা সদরসহ শতাধিক গ্রাম ও পাশ্ববর্তী উলিপুর উপজেলার বেশ কিছু এলাকা।
ফলে দীর্ঘ কয়েকদিন থেকে পানিবন্দি হয়ে প্রায় দুইলক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। শিশু, বৃদ্ধা ও গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে বিপাকে তারা। বাড়িঘরে কোমর থেকে বুক পানি হওয়ায় অনেকে কেচিসড়ক, রেল সড়ক, বাঁধে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়ে গরু, ছাগল ও গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে কষ্টে দিনাপাত করছে। অনেক খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজলেও মেলেনি তাদের ভাগ্যে মাথা গোজার ঠাঁই। কেচি সড়কে আশ্রয় নেয়া খয়বার জানায়, হামার তো কিছু চাই না চাইলেও পাইনা তাই হামরা টেকসই বাঁধ চাই, চাই বন্যার কবল থেকে রক্ষা।
হোসনেআরা বলেন ছোট বাচ্চা আর গরু, ছাগল নিয়ে বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় আসলেও সেখানে উঠেছে পানি বাধ্য হয়ে বাস করছি পানির উপর। গোলাম হাবিব মহিলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ জাকির হোসেন বলেন উপজেলা সদরসহ আশপাশ সকল এলাকা বন্যার কবল থেকে মুক্ত রাখতে হলে পরিকল্পিত ভাবে সড়ক, বাঁধ ও ব্রীজ তৈরি করতে হবে। রানীগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান বলেন উপজেলাকে বন্যা থেকে রক্ষা সড়কটি (কাঁচকোল সড়ক) গত বছরের বন্যার ভেঙ্গে যাওয়ার পর তা মেরামতের জন্য বারবার কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তা মেরামত না করায় দীর্ঘ বন্যার কবলে পড়েছে উপজেলা সদরসহ বেশকিছু এলাকা।
কলেজ শিক্ষক মামুন অর রশিদ বলেন পুরো এলাকার পানি একটি মাত্র স্লুইট গেট দিয়ে বের হচ্ছে। তাই সময় বেশি লাগার কারনে উপজেলাবাসীকে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। কয়েকদিন থেকে উপজেলা সদরের প্রধান প্রধান সড়ক পানিতে ডুবে থাকায় সড়কে খানা খন্দক সৃষ্টি হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। মানুষ ঘোড়ার গাড়ি ও নৌকায় করে যাতাযাত করলেও জলাবদ্ধ পানির দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ। দীর্ঘ বন্যার কবলে পড়ায় দিন দিন অচলের পথে চিলমারী। বন্যার এই সংকট সময়ে বিভিন্ন রোগে আশঙ্কা দেখা দিলেও স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজনকে দেখা মেলেনি বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া বানভাসীদের পাশে।
সুনামগঞ্জ :
সুনামগঞ্জে তৃতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বন্যার পানিতে জেলার ১১টি উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বানভাসি মানুষজন চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। খাদ্য আর বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে বন্যাকবলিত এলাকায়। এ অবস্থায় জেলায় ৩১২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে উঠেছেন। বুধবার সকালে সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ৩১ সে.মি. ও ছাতক পয়েন্টে ১৬৬ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১২০ মি.মি। পানি বাড়ায় নদীর পানি কূল উপচে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নবীনগর, ষোলঘর, কাজীর পয়েন্ট, উকিলপাড়া, উত্তর আরপিননগর এলাকা দিয়ে শহরে পানি প্রবেশ করছে। ছাতক পৌর শহরের বেশিরভাগ এলাকায় পানি ঢুকেছে। দফায় দফায় বন্যায় জেলার লাখো মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
সুনামগঞ্জ শহরের নতুন হাছননগর, বড়পাড়া, পশ্চিম হাজীপাড়া, পূর্ব, পশ্চিম নতুনপাড়া, শান্তিবাগ, বাঁধনপাড়া এলাকার কিছু কিছু বাড়িতে এবং সড়কে আবারো হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি।
একইভাবে সুনামগঞ্জ সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা, ছাতক, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ জগন্নাথপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ায় জনজীবন সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে। প্রতিটি উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নেই বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। সর্বত্র পানি থাকায় রান্নাবান্নাও করতে পারছে না লোকজন। টানা তৃতীয়বার বন্যা আসায় দিশাহারা নিম্নআয়ের মানুষ। পাশাপাশি গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়েও বিপাকে পড়েছে মানুষ।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, আগামী দু’দিন সুনামগঞ্জে বৃষ্টি হবে। অন্যদিকে সুনামগঞ্জের উজানে ভারতের আসাম চেরাপুঞ্জিতে ৪০০ থেকে ৪৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হতে পারে।
সুনামগঞ্জ পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান জানান, বুধবার সকাল ৬টায় সুনামগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীর পানি আবার বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি ধীর গতিতে কমছে। উজানের ঢল নামা অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
বার্তা কক্ষ, ২৩ জুলাই ২০২০