কোভিড-১৯ ভাইরাসে যারা আক্রান্ত হন অথবা যারা এ ভাইরাসের উপসর্গে ভোগেন, তাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন। এরাই হচ্ছেন করোনা যোদ্ধা। চাঁদপুরের এই করোনা যোদ্ধারা এক এক করে কোভিড-১৯ ভাইরাস তথা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন।
ফলে এখন জনগণকে চিকিৎসাসেবা দেয়াটাই ঝুঁকিতে পড়ে গেলো। ডাক্তাররা আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি খারাপ খবর হচ্ছে, যাঁরা নমুনা তথা স্যাম্পল কালেকশান করতেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরী), সেই সম্মুখভাবের করোনা যোদ্ধারা এখন কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এতে করে সীমিত সংখ্যক স্যাম্পল সংগ্রহকারী নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাঁদপুরের স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ।
চাঁদপুর জেলায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর ডাক্তারদের মধ্যে প্রথম আক্রান্ত হন মতলব উত্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আরএমও ডাঃ মেহেদী হাসান। তিনি অবশ্য সময়মতো চিকিৎসা নিয়ে অনেক আগেই পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এরপর আরো কয়েকজন ডাক্তার, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরী), নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ল্যাব টেকনিশিয়ান মোঃ ফারুক হোসেন আক্রান্ত হওয়ার পর সে উপজেলায় করোনায় আক্রান্ত কি না তা চিহ্নিত করতে যে স্যাম্পল কালেকশান করতে হতো, তা অনেকটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তবে সিভিল সার্জনের দ্রুত উদ্যোগে সেখানে আর তখন এ কাজে তেমন একটা সমস্যা হয় নি। আর তখন চাঁদপুরে তথা ফরিদগঞ্জে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলো। এরপর পুরো জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে।
গত কয়েকদিন আগে চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে যিনি সন্দেহভাজনদের স্যাম্পল সংগ্রহ করতেন, তিনি নিজেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যান। ফলে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ স্যাম্পল সংগ্রহ করা নিয়ে বিপাকে পড়ে যায়। দু’দিন স্যাম্পল সংগ্রহ করার কাজ বন্ধও ছিলো। পরে সিভিল সার্জনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটি টিম গঠন করে সেই টিম দিয়ে এবং সদর হাসপাতাল থেকে জরুরি ভিত্তিতে একজন দিয়ে এখন স্যাম্পল সংগ্রহের কাজ চলছে। কিন্তু যখন চাপ বেড়ে যায়, তখন স্যাম্পল সংগ্রহ করা নিয়ে বিপাকে পড়ে স্বাস্থ্য বিভাগ।
এদিকে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই সদর হাসপাতালে যাঁরা নমুনা সংগ্রহ করতেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম আড়াইশ’ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরি) আব্দুল মালেক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন।তাঁকে স্পেশালভাবে ঢাকা থেকে এই তথ্য জানিয়ে দেয়া হয়। এর দু’দিন আগে আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায় আড়াই’শ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ হাবিব-উল-করিমের। তিনি বর্তমানে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।
এরও কয়েকদিন আগে আক্রান্ত হওয়ার রিপোর্ট আসে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুরুত্বপূর্ণ দুই স্বাস্থ্যকর্মী। এভাবে একের পর এক চিকিৎসক, ল্যাব টেকনিশিয়ানসহ স্বাস্থ্য কর্মীরা আক্রান্ত হতে থাকায় অন্যদের মাঝে এখন প্রচন্ড ভীতির সঞ্চার হচ্ছে। বলতে গেলে চাঁদপুর জেলার করোনাভাইরাস সম্পর্কিতসহ অন্য রোগীদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেলো।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, আমরা স্যাম্পল সংগ্রহ করা নিয়ে বিপাকে পড়ে গেলাম। সারা জেলায় মাত্র নয়জন স্যাম্পল সংগ্রহকারী। এদের দিয়েই এ কাজটি করা হচ্ছে। নয় জনের মধ্যে দুইজন আক্রান্ত হয়ে গেলেন।
সদর উপজেলায় যিনি ছিলেন,তিনি আক্রান্ত হওয়ার পর সদর হাসপাতাল থেকে একজন দিয়ে শুধুমাত্র মৃত ব্যক্তিদের স্যাম্পল কালেকশান করার কাজটি অব্যাহত রেখেছি। অন্য যারা স্যাম্পল দিবে তাদেরকে হাসপাতালে এসে দেয়ার জন্য বলে দেয়া হয়েছে। এখন সদর হাসপাতালে স্যাম্পল সংগ্রহ করা একজন আক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় এখানে আর মাত্র একজন রইল। তাই খুব চিন্তিত সামনের দিনগুলো নিয়ে।
তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন জেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করার কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চাঁদপুরেও সামনে এমনই করতে হবে বলে পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দেয়ার বিকল্প দেখছি না। তিনি আরো বলেন, জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা গেলেই করোনা, এমন অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। অথচ তা মোটেই ঠিক নয়। রাত ২টা কি ৩টায় মারা গেলেই করোনা বলে তার স্যাম্পল নিতে এবং বিশেষ ব্যবস্থায় দাফনের জন্যে আমাদের উপর চাপ আসতে থাকে। কিন্তু আমাদেরও তো সীমাবদ্ধতা আছে। প্রশিক্ষিত লোকবল তো পর্যাপ্ত নেই। বরং অনেক সঙ্কট। জ্বর, শ্বাসকষ্ট তো অন্য রোগের লক্ষণও। হৃদরোগে কেউ মারা গেলে মৃত্যুর আগে সে লোকের প্রচুর শ্বাসকষ্ট হয় এটা অনেকেই জানেন। কিন্তু তারপরও এখন শ্বাসকষ্ট হয়ে মারা গেলেই তাকে করোনা সন্দেহ করা হয়। অথচ তার মধ্যে করোনার অন্য উপসর্গগুলো ছিলো কি না তা খোঁজা হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে খুব কঠিন হয়ে যাবে।
সিভিল সার্জন জানান, চাঁদপুর জেলায় এ পর্যন্ত করোনার উপসর্গ নিয়ে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। এতে বুঝা যায় যে, করোনার দু একটি উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেই তাকে করোনা সন্দেহ করা ঠিক নয়। এ ব্যাপারে জনগণকে আরো সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
স্টাফ করেসপন্ডেট,৭ জুন ২০২০