লঞ্চ, রেল চালু এবং সরকারি অফিস খুলে দেয়ায় রোববার রাজধানীতে মানুষের ভিড় বেড়েছে। আর তাদের পরিবহনে ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা, ইজিবাইক চলাচল বেড়েছে। তবে বেশির ভাগ মানুষকে সামাজিক দূরত্ব উপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
এদিন বাইরে চলাচলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে যেসব নির্দেশনা দিয়েছে সরকার, সেগুলো না মেনেই মানুষের চলাচল লক্ষ্য করা গেছে। ছোট্ট ইজিবাইকে সাধারণ সময়ে চালকসহ ৯ জন চলাচল করত; গতকালও একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। রিকশায় দুই থেকে তিনজন যাত্রী এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশায়ও গাদাগাদি করে চলাচল করতে দেখা গেছে।
রাস্তাঘাট, ফুটপাত, কাঁচাবাজার, বিভিন্ন দোকানপাটেও কর্মব্যস্ত নগরবাসীকে খুবই কাছাকাছি থেকে চলাচল করতে দেখা গেছে। এসব স্থানে কেউ কেউ স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক ও হ্যান্ডগ্লাভস পরেছেন। আবার অনেকে এসবের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না।
রোববার সকালে গাবতলী গরুর হাট সংলগ্ন প্রধান সড়কে অপেক্ষা করে বিভিন্ন মাধ্যমে ঢাকায় আসা মানুষকে রিকশা, সিএনজি, অটোরিকশায় চড়ে নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরিশাল থেকে সদরঘাট হয়ে ঢাকায় আসা ৩ জন শ্রমিক সিএনজিযোগে গাবতলী এসে ইজিবাইকে সাভারের উদ্দেশে রওনা হন।
ওই ইজিবাইকে চালকসহ ছিলেন ৯ জন। চালকের মুখে মাস্ক ছিল না, তবে যাত্রীদের সবার মুখে মাস্ক ছিল। এ বিষয়ে ইজিবাইকের চালক ইলিয়াস হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘অনেকদিন বেকার।
কয়েকদিন হল গাড়ি বের করেছি। ৯ জনের স্থানে ৪-৫ জন নিয়ে চালানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা কম হওয়ায় যাত্রীরা উঠে পড়ছে। আর গরমের কারণে মাস্ক পরতে পারছি না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার জন্য ঝুঁকি রয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু জীবিকার প্রয়োজনে আল্লাহর ওপর ভরসা করে পথ চলা শুরু করেছি। আল্লাহ বাঁচায়ে রাখলে বাঁচব, নইলে মারা যাব। এখন এর বাইরে অন্য কিছু ভাবতে পারছি না।’
গাদাগাদি করে কেন গাড়িতে উঠল যাত্রীদের কয়েকজনকে এমন প্রশ্ন করলে তারা বিরক্তি প্রকাশ করে মুখ ঘুরিয়ে নেন। সকালে গাবতলী থেকে আমিনবাজার, সাভার, মোহাম্মদপুর-হাজারীবাগ সেকশন ও বাবুবাজারের উদ্দেশে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, টেম্পো, ইজিবাইক চলাচল করতে দেখা গেছে।
অনেকদিন পর হেলপারদের গাবতলী.., গাবতলী…সহ বিভিন্ন স্থানের নামে যাত্রীদের ডাকতে দেখা গেছে। গাবতলী টার্মিনাল ও আশপাশের এলাকার বাসকাউন্টারগুলো খুলতে দেখা গেছে। এসব কাউন্টারের সামনে বেশকিছু বাস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
রাজধানীর বিভিন্ন সিগন্যালে ট্রাফিক পুলিশকে সতর্ক অবস্থায় দেখা গেছে। গাড়ির সংখ্যা বাড়ায় ব্যস্ততম সিগন্যালে কিছুক্ষণ পরপর বিভিন্নমুখী গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে। সরেজমিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মানুষের প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়। এ সময় গায়ে গায়ে লেগে মানুষকে চলাচল করতে দেখা গেছে।
এছাড়া চা বিক্রেতা, ডাব বিক্রেতা, ফুটপাতের বিভিন্ন দোকানপাটের পসরা শনিবারের তুলনায় অনেকাংশে বেড়েছে। মহানগীর কারওয়ান বাজার, হাইকোর্ট মোড়, গুলিস্তান, মগবাজার, পুলিশ প্লাজা, হাতিরঝিল, গুলশান-১, গুলশান-২, গুলশান, কুড়িল, জোয়ার সাহারা এলাকার সব ধরনের দোকানপাট খোলা রাখতে দেখা গেছে।
সরকারিভাবে গণপরিবহনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধানের কথা বলা হলেও গতকাল পুরান ঢাকা থেকে সচিবালয়মুখী বাসে প্রত্যেক সিটে যাত্রী এবং কয়েকজনকে দাঁড়িয়েও চলাচল করতে দেখা গেছে।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা ও নগরপরিকল্পনাবিদ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সরকার অফিস খুলেছে। যথানিয়মে অফিস শুরু করেছি। যতদিন সুস্থ থাকি নিয়মিত অফিস করে যাব।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা উপকরণ হিসেবে শুধু মাস্ক পরছেন এবং এ বিপদ থেকে বাঁচতে বেশি বেশি সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছেন। জনঘনত্বপূর্ণ রাজধানী ঢাকায় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাচল করা সম্ভব নয়।
ঝুঁকি নিয়ে ভাড়ায় যাত্রী নিচ্ছে মোটরসাইকেল : রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে চলছে চুক্তিভিত্তিক মোটরসাইকেল। রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাপে সেবা দেয়ার সুযোগ বন্ধ থাকায় এসব মোটরসাইকেল চালক রাস্তায় নেমে চুক্তিতে যাত্রী নিচ্ছে। রোববার ঢাকার শাহবাগ, বাংলামটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় এমনই চিত্র দেখা গেছে।
করোনার মহামারী ঠেকাতে রাইড শেয়ারিং সেবাও বন্ধ রাখা হয়েছে। গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত অ্যাপভিত্তিক যানবাহন চলাচলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। এ অবস্থায় কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন এ পেশায় থাকা শত শত মানুষ।
শাহবাগ মোড়ে ৪-৫ জন চালককে দাঁড়িয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তাদের একজন জানান, প্রায় দুই মাস বেকার থাকার পর বাধ্য হয়েই মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমেছি। তিনি বলেন, যতটুকু সম্ভব স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করেই বাইক চালাচ্ছি। তিনি বলেন, আগে একাধিক অ্যাপে তিনি ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন কিন্তু অ্যাপের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এখন চুক্তিতে চালাচ্ছেন।
দুপুরে বাংলামটর মোড়ে দেখা যায়, ৭-৮ জন চালক মোটরসাইকেল নিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন। অ্যাপ তো এখনও চালু হয়নি, আপনারা কীভাবে চালাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে কামাল হোসেন নামের এক চালক বলেন, চুক্তিতে চালাচ্ছি। মানুষেরও উপকার হচ্ছে, আমাদেরও সংসার চলছে।
স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সবই বুঝি ভাই, কিন্তু পকেটে টাকা না থাকলে কি ঢাকায় বসবাস করা যায়?
একই চিত্র দেখা গেছে কারওয়ান বাজার, কাকলী মোড় এলাকায়। সেখানে মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েকজন। কোনো পথচারীকে সামনে পেলেই কোথায় যাবেন জানতে চান তারা। এ সময় কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে ভাড়া নিয়ে তাদের দর কষাকষি করতে দেখা গেছে।
এদিকে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. ইউছুব আলী মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, রাইড শেয়ারিং সেবার বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই এ বিষয়ে আপাতত কিছু বলা যাচ্ছে না।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, মোটরসাইকেলে যাত্রী বহনে চালক ও যাত্রী দুজনেরই ঝুঁকি থেকে যায়। যদি কোনো যাত্রী করোনাভাইরাস বহন করে থাকেন তবে তার দ্বারা মোটরসাইকেল চালক সংক্রমিত হবেন। আর ওই চালকের দ্বারা অন্য যাত্রীরাও সংক্রমিত হতে পারেন।
ঢাকা ব্যুরো চীফ,১ জুন ২০২০