Home / বিশেষ সংবাদ / করোনাভাইরাস : মানব জাতির অহংকারের বিরুদ্ধে প্রকৃতির প্রতিশোধ
করোনাভাইরাস
করোনায় মৃত কোনো এক ব্যক্তির দাফন হচ্ছে।

করোনাভাইরাস : মানব জাতির অহংকারের বিরুদ্ধে প্রকৃতির প্রতিশোধ

জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নোভেল করোনাভাইরাস পৃথিবীর কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এতো বড় যুদ্ধ, এতো কঠিন যুদ্ধ বোধহয় আগে কখনো মানুষকে লড়তে হয়নি। যে যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে চোখে দেখা যায় না।

যে যুদ্ধে গুলি, বোমা, রকেট লঞ্চার, এমনকি কোনো পরমাণু অস্ত্রও কার্যকর হয় না। অথচ যে যুদ্ধে আণুবীক্ষণিক মারণ প্রতিপক্ষ ‘কোভিড ১৯’ তথা নোভেল করোনাভাইরাস মুখোমুখি হতে হচ্ছে নিরস্ত্র মানুষকে । না, ঠিক নিরস্ত্র নয়। বরং সাবান জল, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, অক্সিজেন, আর পরীক্ষামূলকভাবে কিছু প্রচলিত ওষুধ নিয়ে ওই অসম যুদ্ধটি স্থায়ী অস্থায়ী হাসপাতালে লড়তে হচ্ছে হাজার হাজার ডাক্তার, নার্স আর স্বাস্থ্যকর্মীকে।

কারণ চীনের উহান থেকে বেরিয়ে অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সারা পৃথিবীব্যাপী খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ওই কোভিড ১৯’ র বিরুদ্ধে লড়বার মতো কোনো অস্ত্র এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। অথচ তার অশরীরি হানাদারিতে একের পর এক দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এবং মৃত্যুর সংখ্যাটিও অচিরেই হয়তো দুই লক্ষে পৌঁছে যাবে।

এমনই দ্রুতগামী সে, এমনই তার ব্যাপকতা! যে আমজনতা থেকে পৃথিবীর বিপুল ঐশ্বর্যর অধিকারী এবং প্রবল শক্তিমানদের ওপরেও সে নিমেষে তার মারণ স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে। একেবারে শীর্ষস্থানীয় রাজপুরুষ, রাজকন্যা থেকে নানা দেশের মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, বিখ্যাত অভিনেতা, অভিনেত্রী, সাহিত্যিক, ডাক্তার, খেলোয়াড় – এমনকি বিজ্ঞানীও সেই আক্রান্তের তালিকায়!

তবে এমন নয় যে, আমাদের বসুন্ধরা এই প্রথম কোনো মহামারি প্রত্যক্ষ করল। এমনও নয় যে, সেই মহামারির হানায় লক্ষ মানুষ আগে প্রাণ হারায়নি। বরং জানতে পারছি, প্রায় ৫০০০ বছর আগে এক মহামারিতে সেই চিনেরই একটি প্রাগৈতিহাসিক গ্রাম অধুনা ‘হামিন মঙ্ঘা’ নামে পরিচিত, জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল। এবং প্রায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল সমসাময়িক উত্তর-পূর্ব চিনেরই আরও একটি অঞ্চল ‘মিয়াওজিগউ’।

এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ থেকে একেবারে ১৭৭২ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে প্লেগের তান্ডব শত-সহস্র বছর ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে।

তারপর থেকে ২০১০ পর্যন্ত ইয়োলো ফিভার ও সোয়াইন ফ্লু’ র দাপটে পৃথিবীর কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণ গেছে। আর ২০১৪ থেকে ইবোলা এবং ২০১৫ থেকে একেবারে বর্তমান সময় পর্যন্ত জিকা ভাইরাসের আক্রমণও কম মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়নি।তবে মনে হয়, এর কোনোটাই নোভেল করোনাভাইরাস এর মতো প্রায় একসঙ্গে সারা বিশ্বে এমন দ্রুততায় ছড়িয়ে পড়েনি।

আসলে প্রকৃতির কাছে মানুষ যে কত অসহায়, তা যেন আরও একবার আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে স্বয়ং প্রকৃতিই। মনে হচ্ছে, যত পেশীশক্তি, যত আধুনিক মারণাস্ত্রেই সে বলীয়ান হোক না কেন, একটা ভাইরাসের কাছে তার সমস্ত দর্প, সমস্ত অহঙ্কার যেন মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়ছে।

চীনে উহানের যে মাছ মাংসের বাজার, যেখানে বাদুড়, সিভেট, প্যাঙ্গোলিনের মতো নানা বন্যপ্রাণীর মাংস বিক্রি হয়, সেখান থেকেই নাকি ওই মারণ ভাইরাসটি প্রথম ছড়িয়েছিল। অবশ্য বাদুড়, না প্যাঙ্গোলিন, নাকি অন্য কোনো বন্যপ্রাণী, সারা বিশ্বকে ওই কোভিড ১৯ ভাইরাসটি উপহার দিয়েছে, বিজ্ঞানীরা এখনো সেই বিষয়ে নিশ্চিত নন।

তবে আমরা জানি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশেই নানা বন্যপ্রাণী খাওয়ার চল আছে। এবং উত্তর পূর্ব ভারতের কিছু রাজ্যেও তেমনটাই দেখেছি। এবং বিশেষত চীনে সনাতনি ওষুধ তৈরিতে বন্যপ্রাণীদের দেহাংশ ব্যবহার হয়। আর সেই চাহিদা মেটাতে পৃথিবীর অসংখ্য বন্য প্রাণ বিপন্নের তালিকায় ক্রমাগত নাম লিখিয়ে চলেছে।

এবং প্যাঙ্গোলিন তো জানি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অবৈধ পাচার হওয়া বন্যপ্রাণীর মধ্যে প্রথম স্থানটি দখল করে আছে। যার মাংস চীন সহ আরো কিছু দেশে খুবই উপাদেয় খাদ্য এবং চীনের সনাতনি ওষুধের উপাদানও বটে।

তাই তাদের অপরিসীম চাহিদা মেটাতে একের পর এক দেশের বন্য প্রাণ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এবং মানুষের (এক শ্রেণীর) হাত থেকে নিজের ওই অসহায় সন্তান সন্ততিদের পৃথিবী রক্ষা করতেও পারছে না। এবং মানুষই সর্বতোভাবে ধ্বংস করতে করতে তাকে এতোটাই বিষে জর্জর করে তুলেছে যে, সে ক্রমশই তার বাসযোগ্যতাও হারাচ্ছে।

তাই হয়তো কেউ কেউ বলছেন পৃথিবীব্যাপী এই মহামারি আসলে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’। প্রতিশোধ কি না জানি না। তবে এবার করোনাভাইরাস হঠাৎ আক্রমণে দিশেহারা মানুষ খুবই ভয় পেয়েছে। বিশ্ব জুড়ে তারা নিজেদের পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। সংক্রমণ ঠেকাতে মেলামেশা তো দূরের কথা, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলতেও যেন ভয় পাচ্ছে। এমনটা কি আগে কখনো ঘটেছে?

মনে হচ্ছে, এই নতুন মারণ ভাইরাসটি যেন এক অদৃশ্য দণ্ড হয়ে আমাদের সতর্ক করতে চাইছে। যেন সাবধান করতে চাইছে এই বলে যে, বসুন্ধরার প্রকৃতি ও পরিবেশের এমন নির্বিচার ধ্বংস অভিযানে লাগাম পরাও। তা না হলে তার মূল্য কিন্তু চোকাতেই হবে।

সত্যি তো, আমরা কি গোটা পৃথিবীতে এমন জরুরি অবস্থা কখনো জারি হতে দেখেছি? আগে কখনো দেখেছি কি সারা বিশ্বের অর্থনীতির শিকড় ধরে এমন টান মারছে একটা অশরীরি ভাইরাস?

তাই কেবলই মনে হচ্ছে, পৃথিবীর এক নিঃশব্দ বার্তা যেন ইথার তরঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে – তুমিই আমার শেষতম সৃষ্টি। অথচ দেখ, কি প্রবল ঔদ্ধত্য আর অহমিকায় সেই তুমিই নবীন কিশোর আমাকে, আমার সমস্ত সৃষ্টিকে কেবলই ধ্বংস করে চলেছ! এবং তুমি নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মনে করলেও, আসলে নিজেই নিজেকে ক্রমাগত ধ্বংসের অনিবার্যতার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছ।  আরো পড়ুন- করোনাভাইরাস নিয়ে ১১ মাস আগেই সতর্ক করেছিলেন চীনা ল্যাবের গবেষক

মালবী গুপ্ত, bbc সাংবাদিক, কলকাতা।  ২১ এপ্রিল ২০২০