সুদীর্ঘ ৩৫ বছর শিক্ষকতা পার করে অবসরে গেলেন চাঁদপুর সদরের উত্তরে সফরমালী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল গনি। তিনি ১৯৮৮ সালের ১ আগস্ট এ বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর চাচা মনিপুর মুলামবাড়ি প্রাথমিক স্কুলের সাবেক প্রধানশিক্ষক মৃত আহমেদ আলী মাস্টারের অনুপ্রেরণায় ১৯৮৩ সালে তিনি চাঁদপুর সদরের জোহরা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় মহান শিক্ষকতা পেশায় সর্বপ্রথম প্রবেশ করেন।
অত:পর কিছুকাল আক্কাস আলী রেলওয়ে একাডেমিতে শিক্ষকতা করার পর বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে তিন বছর অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি করেন। এরপর তিনি সফরমালী হাই স্কুলে যোগদান করে একজন জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
শিক্ষকতায় তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের কাছে একজন আদর্শের প্রতীক। কেননা তিনি অসংখ্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজকে একজন দক্ষ শিক্ষক হিসেবে স্কুলের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণে একাগ্রচিত্তে সকল প্রকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা ও উপস্থাপনা, দিক-নির্দেশনা এবং দেশের জাতীয় দিবসগুলো পালনে অগ্রণী ভূমিকা,দৈনিক সমাবেশ পরিচালনা,পরিবেশ রক্ষার কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে পারদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন। যে কোনো অনুষ্ঠান পরিচালনা ও উপস্থাপনায় স্কুলে তিনি ছিলেন অতুলনীয় ।
শ্রেণিকক্ষে ইংরেজি ও বাংলা দ্বিতীয় পত্রের একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে শিক্ষার্থীদের আস্তা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে ৫ বার দায়িত্ব পালন করে শিক্ষার্থীর শিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি স্কুলের ড্রেস প্রচলন,আধুনিক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু,নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা ও শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষায় এগিয়ে ছিলেন অন্যসব শিক্ষকদের তুলনায় ।
তাঁর মতে,শিক্ষকতা জীবনে অবদান কম হলেও প্রাপ্তি অনেক বেশি। কম হলেও ২৫-২৬ টি পেশাগত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। তাই মনের মাধুরী দিয়ে বিদ্যালয়টিকে সাজাতে ও শিক্ষার্থীদের কিছু দেবার চেষ্টার কমতি ছিলো না তাঁর। তিনি একজন ধূমপানের মত ব্যাডহেভিটমুক্ত ব্যক্তিত্ববান আদর্শ শিক্ষক ছিলেন।
তিনিই প্রথম ১৯৯০ সালে চাঁদপুর রোটারেক্ট ক্লাব এর সৌজন্যে প্রদানকৃত বিদ্যালয়ের চারপাশে শিক্ষার্থীদেরকে উদ্ভদ্ধ করে মূল্যবান বৃক্ষরোপন করেন এবং স্কুলের চারপাশটিতে ছায়ানিবিড় পরিবেশ তৈরি করে এলাকাবাসীর দৃষ্টি আর্কষণ করেন। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সম্মতিক্রমে ২০০৬ সালে তাকে মূল্যবান বৃক্ষরোপনে অবদান রাখায় ধন্যবাদসহ ৫ হাজার টাকার প্রাইজবন্ড পুরস্কার দেয়া হয়।এতে প্রমাণিত হলো তিনি স্কুলের একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক।
এলাকার শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত আস্থাভাজন সৎ চরিত্র ও দায়িত্ববান শিক্ষক হিসেবে দিন দিন পরিচিতি লাভ করেন। তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ সফরমালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের‘ স্কুল-ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমিক শিক্ষক প্রতিনিধি’ হিসেবে এলাকার শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদান রাখেন।
তিনি ১৯৯৭ সালে তাঁর নিজের সম্পাদনায় স্কুলের পুর্ব ইতিহাস,চলমান ও সাবেক বিদায়ী শিক্ষকদের নামের তালিকা,সাবেক প্রধানশিক্ষকদের তালিকা স্কুল ম্যানেজিং কমিটির বর্তমান ও সাবেক নাম ,দাতা ও প্রতিষ্ঠাতাদের নাম,বৃত্তিপ্রাপ্তদের নাম ও ফলাফল এবং বাণী নিয়ে স্কুলটির ৮৬ বছরের ইতিহাসে এটাই প্রথম ও এটাই শেষ স্কুল ম্যাগাজিন ‘ দর্পণ’ তিনিই প্রকাশ করেছিলেন । পববর্তীতে তিনি এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পরিচিতি নিয়ে কয়েকটি স্মরণিকা প্রকাশ করেন। এছাড়াও প্রশিক্ষণকালীন সময়ে ইংরেজি ও বাংলায় বেশ কটি ‘ সুভ্যিনর ’ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ।
তাঁর সতীর্থরা সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ব্যাংক বীমার অফিসার, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকসহ অনেকেই বড় মাপের অনেক ভালো অবস্থানেই আছে। যা মাঝে মধ্যে আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করার মত বিষয় । সবচেয়ে ভালো অনুভূতি হলো এ পেশার বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অনেক বড়মাপের মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে তাঁর । তিনি স্কুলের পাশেই পরিবার-পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সুযোগে স্কুলের সকল প্রকার অর্পিত দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পেরেছেন।
আবদুল গনি ১৯৬০ সালের ১২ মার্চ হাইমচর উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নে ঈশানবালার এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তারঁ বাবার নাম মৃত মোহাম্মদ আলী মুন্সী তিনি ছিলেন একজন আদর্শ কৃষক ও নিজের প্রতিষ্ঠিত মুনিপুর মুলামবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। মা নূরজাহান বেগম একজন গৃহিণী ছিলেন। ছোটবেলায় মা-বাবার নিকট মক্তবেই তিনি আদর্শ শিক্ষা নেন।
১৯৭৮ সালের হাইমচর উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৮০ সালে সাহাতলী জিলানী চিশতী কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৮২ সালে চাঁদপুর সরকারি কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। হাইমচরের নদীভাঙ্গনগ্রস্থ একটি পরিবারের সদস্য হওয়ায় জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত,দু:খ-দুর্দশা,আনন্দ-বেদনা,হাসি আর কান্নার মধ্যে তাঁর শিক্ষাজীবন পার করতে হয়েছে।
চাঁদপুর সরকারি কলেজে অধ্যয়নকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ) এর সক্রিয় সদস্য হিসেবে চাঁদপুর কলেজে সংসদ নির্বাচন করেন। সে নির্বাচনে গাজী গোলাম মোস্তফা-শাহনেওয়াজ প্যানেল জয়লাভ করে । তিনি ছিলেন জাসদ সর্মথিত সাহাজাহান-দুলাল পরিষদের সমাজকল্যাণ পদের প্রার্থী।
শিক্ষকতা জীবনের শুরু থেকেই ১৯৮৭ সালে থেকে মাধ্যমিক শিক্ষক সংগঠন এবং বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের
প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন । শিক্ষকদের দাবি আদায়ের আন্দোলন চাঙ্গা হতে থাকলে তিনি ১৯৮৮ সালে তৎকালীন ডিএন হাই স্কুলের সাবেক প্রধানশিক্ষক মরহুম সাখাওয়াত হোসেন, প্রয়াত তাঁর শিক্ষক অরুণ মজুদার ও বাকশিস নেতা অধ্যক্ষ সাফায়াৎ আহমেদের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হন।
প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে শিক্ষকদের দাবি আদায়ে একজন সৈনিক হিসাবে চাঁদপুরের সকল শিক্ষক সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ ১৯৮৭, ১৯৯০ , ১৯৯১, ১৯৯৪, ১৯৯৭, ১৯৯৮ , ২০০০, ২০০১, ২০০৪, ২০০৫ , ২০০৮, ২০১০ ২০১২, ২০১৫ , ২০১৬ ও ২০১৭ সালের শিক্ষকদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন এবং শিক্ষক সংগঠনগুলোর সকলকাজে নিজকে সম্পৃক্ত রাখেন ।
১৯৯৪ সালে ‘জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট ’ গঠন হলে এর প্রচার সম্পাদক ও পরবর্তীতে তথ্য ও প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব দু বার পালন করেন। বাকশিস সভাপতি ড.অধ্যক্ষ আলমগীর কবির পাটোয়ারী সংগঠনের এক সভায় সর্বসম্মতিক্রমে তাকে সংগঠনের একজন মুখপাত্র হিসেবে মিডিয়ার দায়িত্ব প্রদান করেন । সে থেকেই তিনি চাঁদপুরসহ কেন্দ্রীয় আন্দোলন-সংগ্রামের ছবি ও সংবাদ সংগ্রহ করে স্থানীয় চাঁদপুরের পত্রিকাগুলোতে সংবাদ পরিবেশন করতে অভ্যস্থ হন ।
২০১৪ সালে শিক্ষক সংগঠনের দুরবস্থার কথা ভেবে চাঁদপুরে ‘জেলা মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করতে চারজনের মধ্যে তিনিও একজন সক্রীয় সদস্য ছিলেন এবং সাংগঠনটির একটি গঠনতন্ত্র ৩ বছর সময়ে প্রনয়ণের দু’জনের মধ্যে তিনি একজন। শিক্ষক সংগঠনের কাজে তিনি চাঁদপুরের সকল উপজেলায় গিয়ে প্রায় ২শ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যান।
দেশে প্রেমের নিদর্শন হিসেবে বলা যায়-১৯৮৫ সাল থেকেই চাঁদপুরের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও জাতীয় দৈনিকে চাঁদপুর-হাইমচরের নদীভাঙ্গন,চরবাসীর জীবন-জীবিকা,জেলার উন্নয়ন চিত্র,শিক্ষকদের কথা,পরিসংখ্যান,মৎস্য সম্পদ,কৃষি, শিক্ষা,স্বাস্থ্যসেবা ও সাধারণ মানুষের জীবনালেখ্য নিয়ে লেখালেখিতে অভ্যস্ত হন।
১৯৮৮ সালের বন্যায় চরের মানুষের জীবনের কথা ও হাইমচরের দীর্ঘ ৫০ বছরের নদীভা্গংতি মানুষের কথা লিখতেই তিনি পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিতে মনোনিবেশ করা শুরু করেন । এর ফলে তাঁর ভেতর দেশপ্রেমের উদাহরণ খূঁজে পাওয়া গেছে ।
‘জাতীয় মাছ ইলিশ সম্পদ রক্ষায় ২০০২’ সালে ‘ পলিথিনের মত কারেন্ট জালের উৎপাদন,বাজারজাত ও বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হউক’একটি প্রতিবেদন চাঁদপুরেরসহ জাতীয় ক’টি পত্রিকায় প্রকাশ পেলে তৎকালীন মৎস্য অধিদপ্তরের দৃষ্ঠি আকর্ষণ হয় এবং পরে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় চালান হওয়া জাটকা সম্পর্কে প্রতিবেদন লেখলিখেতে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
অত:পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে জাতীয় এ ইস্যুতে কথা বলতে একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। যা পরবর্তীতে সংশোধিত আকারে ১৯৫০ সালের মৎস্য আইনটি সংসদে উপস্থাপিত হয় এবং জাতীয় সম্পদ রক্ষায় এটি কন্ঠভোটে পাশ হয় । এ আইনটি তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি ড.ইয়াজউদ্দিন ২০০৩ সালের ২৩ সেপ্টম্বরে স্বাক্ষর করেন । স্কুল থেকে সংবর্ধনাও দেয়া হয়েছিল তাঁকে ।
বর্তমানে ২০০৩ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি,অভয়াশ্রম সংরক্ষণ ও ইলিশ সম্পদ রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে।
আব্দুল গনি দু’সন্তানের সৌভাগ্যশীল বাবা। তিনি ১৯৯৪ সালে বিয়ে করেন । তাঁর সহধর্মিণী একজন গৃহিণী। লেখাপড়া হাইমচর বালিকা বিদ্যালয় পার করে মিরপুর বাংলা কলেজ পর্যন্ত। তার প্রথম ছেলে আনোয়ার জাহিদ চাঁদপুর সরকারি কলেজের মাস্টার্স অধ্যায়নরত এবং ছোট ছেলে বিএসসি অনার্স প্রাণিবিজ্ঞান ২য় বর্ষে বর্তমানে অধ্যয়ন করছে।
আবদুল গনি ৩৫ বছরের এ পার্থিব শিক্ষকতায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, দু:খ-দুর্দশা, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার মত অনেক স্মৃতিবিজড়িত প্রেক্ষাপট ও অভিজ্ঞতার প্রান্তে মহান এ পেশার সফল সমাপ্তি টেনেছেন ১১ মার্চ ২০২০ সালে । জীবন সায়াহ্নের এ বিকেলে সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুর জন্যে তাঁর ফেইজবুক স্ট্যাটাসে তিনি দোয়া প্রার্থনা করলে কয়েক শ’ শিক্ষার্থী তাঁর সফল ও কৃতিত্বপূর্ণ মহান শিক্ষকের ভূঁয়শী প্রশংসা করে তাদের মতামত জানান ।
১১ মার্চ ২০২০ তিনি শিক্ষক কাউন্সিলের এক সভায় অনানুষ্টানিকভাবে অবসর গ্রহণ করার মতামত ব্যক্ত করে কেবলমাত্র সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নেন । আরো পড়ুন-চাঁদপুরের সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রাক্তন শিক্ষক আবদুল গনি’র জন্মদিন
লেখক : মো.ইকবাল হোসেন , প্রাক্তন ছাত্র, সফরমালী উচ্চ বিদ্যালয় ও জুনিয়র ইন্সিট্রক্টর, বাংলাদেশ স্কীল ডেভেলপমেন্ট ইন্সিটিটিউট ,বাবুরহাট,চাঁদপুর ,১৮ মার্চ ২০২০