প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরবসহ অন্তত ২০টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি স্থগিত রয়েছে। আমদানি-রফতানি বন্ধ থাকায় দেশের ৩৬টি খাতের মধ্যে ১৪টিতে ক্ষতি হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা।
দিন যতই যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে পড়ছে। এসব খাতের ক্ষতিপরিমাণ আরও বাড়ছে। বাকি খাতের অবস্থাও একই। করোনায় বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে সংকট ধেয়ে আসছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংক, বিমা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত-অতালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
জাতিসংঘ সংস্থা আঙ্কটাডের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড কমোডিটিস ডিভিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ছোঁয়াচে এই রোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ২০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও।
রফতানি উন্নয়ন বুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আটমাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ২ হাজার ৬২৪ কোটি ১৮ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। যা এর আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে যা ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ কম।
আট মাসের মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবৃদ্ধি ও লক্ষ্যমাত্রা কোনটাই স্পর্শ করতে পারেনি দেশের তৈরি পোশাক খাত। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। একই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
একক মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে রফতানি আয় অর্জিত হয়েছে ৩৩২ কোটি ২৩ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার। অর্থাৎ ৩০কোটি ডলার কম।সে হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা কমেছে ১০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। একই সঙ্গে ১ দশমিক ৮০ কম প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে।
ইপিবি’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সব ধরনের পণ্য রফতানিতে বৈদেশিক মুদ্রার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষ রফতানি আয় অর্জিত হয়েছে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৫০ লাখ ৪ হাজার ডলার।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তৈরি এক প্রতিবেদন বলা হয়, রসুন, আদা, লবণ, মসুর ডাল, ছোলা, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচসহ চীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৪টি খাতের আমদানি-রফতানি বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে চীন থেকে আমদানি বেশি হচ্ছে শিল্পের যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামাল, রাসায়নিক পণ্য, কাপড়, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, ইলেকট্রনিক্স পণ্য।বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানি হচ্ছে-তৈরি পোশাক, হিমায়িত পণ্য, ফার্নিচার, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পণ্যের ক্ষতি বেশি হচ্ছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ ১ হাজার ৩৮৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর বিপরীতে চীনে রফতানি করেছে ৮৩ কোটি ডলারের পণ্য।বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে।রফতানির মোট রফতানির ২ শতাংশ যায় চীনে।
সূত্র মতে, চীন থেকে আমদানির তালিকায় বেশির ভাগই রয়েছে শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল।এছাড়া বেশ কিছু তৈরি পণ্যও আমদানি হয়। করোনার প্রভাবে বর্তমানে চীন থেকে নতুন করে কোনো পণ্য আসছে না।ফলে চীনের কোনো পণ্য এখন পাইপলাইনেও নেই।
এছাড়া ব্যাংকগুলোতে চীন থেকে পণ্য আমদানির কোনো এলসি খোলা হচ্ছে না। এতে চীন থেকে যেসব শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হওয়ার কথা সেগুলোর স্থাপন কার্যক্রম এখন বন্ধ। যেসব শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল চীন থেকে আসে সেগুলোর মজুদ এখন প্রায় শেষ হওয়ার পথে। ফলে কাঁচামাল সংকটে সংশ্লিষ্ট শিল্প খাতটি এখন সংকটে পড়তে পারে।
ব্যবসায়ী শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এই অবস্থা থেকে উত্তোরণে চীন থেকে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তার বিকল্প উৎস জরুরি ভিত্তিতে খুঁজে বের করার আহবান জানিয়েছে সরকারকে। পাশাপাশি এসব বিকল্প সূত্র থেকে এলসি খোলার মাধ্যমে পণ্য আমদানিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে সমন্বয় বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রলণালয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করার সুপারিশ করা হয়।
এছাড়াও দেশের বাহিরের মিশনগুলোতে আউট সোর্সিং সেল খুলে স্বল্প ও দীর্ঘকালীন যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা। আগামী দিনে যাতে আর কখনো ভোগান্তিতে পড়তে না হয় তা নিশ্চিত করে সরকারিভাবে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়।
জাতিসংঘ সংস্থা আঙ্কটাডের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড কমোডিটিস ডিভিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে চীনের মধ্যবর্তী পণ্য রফতানি ২ শতাংশ কমলে যে ২০টি দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। বাংলাদেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্প খাত, কাঠ ও ফার্নিচার শিল্প এবং চামড়াশিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। শীর্ষ ২০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ থাকলেও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই।
চীনে করোনাভাইরাস আঘাত হানায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ২০ দেশের তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে-ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, বেলারুশ, ব্রাজিল, কানাডা, কোস্টারিকা, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইসরায়েল, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, মরক্কো, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিপাইন, সৌদি আরব, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, তিউনেশিয়া, তুরস্ক, ইউক্রেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৫ দেশ হলো-ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও ভিয়েতনাম।
ঢাকা ব্যুরো চীফ,৭ মার্চ ২০২০