ভোগ্যপণ্যের উচ্চমূল্যে আগে থেকেই সাধারণ মানুষ চিড়েচ্যাপ্টা। এবার একই সঙ্গে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোয় সংসার চালানো দায় হয়ে পড়ছে মধ্যবিত্তদের কাছে। আয় বৃদ্ধির কোনো বালাই নেই, নানাভাবে বাড়ছে শুধু ব্যয়। এ কারণে সংসারে আয়-ব্যয়ে তালে তাল মেলাতে পারছেন না স্বল্প আয়ের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ। তাদের জীবনযাত্রা ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
দেশে প্রায় ৪ কোটি অতিদরিদ্র মানুষ। ৮ কোটি নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ। ৪-৫ কোটি মধ্যবিত্ত আর বাকি ১ কোটি মানুষ উচ্চবিত্ত। একসঙ্গে বিদ্যুৎ-পানির দাম বৃদ্ধির কারণে ওই ১ কোটির হয়তো তেমন কোনো সমস্যা হবে না, কিন্তু চরম বিপাকে পড়তে হবে বাকি ১৬ কোটি মানুষকে। এর মধ্যে আবার যে ৪ কোটি মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা তাদের তো এখন টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়বে। এমনটিই মনে করছেন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।
ক্যাব সভাপতি বলেন, যেকোনো জিনসের দাম বাড়লে সবার আগে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় হতদরিদ্র মানুষগুলোকে। তাদের টানাপড়েনের জীবনমানে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জীবনমান হুমকির মুখে পড়ে। প্রায় একইভাবে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবনও বিষিয়ে তোলে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি। অথচ ওই যে এক কোটি ধনী লোক যারা আছে, তাদের মধ্যে অনেকেই আছে ব্যাংক লুটেরা, ঋণখেলাপিসহ সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা নেওয়া। অথচ সরকার ১৬ কোটি মানুষকেই বারবার কষ্ট দিচ্ছে বেশি ওই এক কোটিকে সুবিধা দিতে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ সময়ে এক সঙ্গে পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে সরকারকে সাধারণ মানুষের কষ্টের বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত ছিল।
গত বৃহস্পতিবার সরকার একসঙ্গে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়িয়েছে। এদিন গ্রাহক (খুচরা) পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানোয় বিলের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩৬ পয়সা যোগ হবে, যা আজ ১ মার্চ থেকেই কার্যকর হবে। প্রতি ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়েছে। পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম প্রতিইউনিট গড়ে ৪০ পয়সা বা ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। ৪ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বেড়ে প্রতিইউনিটের দাম হয়েছে ৫ টাকা ১৭ পয়সা।
এছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন মূল্যহার বা হুইলিং চার্জ প্রতিইউনিটে শূন্য দশমিক ২৭৮৭ থেকে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ শূন্য দশমিক ২৯৩৪ টাকা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মূল্যবৃদ্ধির এ ঘোষণা দেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল।
এছাড়া একই দিন ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির দামও ফের বাড়ানো হলো। ঢাকা ওয়াসার প্রতি হাজার লিটার পানি আবাসিকে ২.৮৯ ও বাণিজ্যিকে ২.৯৬ টাকা বেড়েছে। আর চট্টগ্রামে আবাসিকে ২.৪৮ এবং বাণিজ্যিকে ২.৭৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে গত ১২ বছরে ১৩ বার বাড়ানো হলো পানির দাম।
পানি-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি যে কেবল মাস শেষে বিলের কাগজে কিছুটা বাড়তি টাকা যোগ হবে, বিষয়টি তা নয়। এর প্রভাব পড়বে সব কিছুতেই। এমনিতে গত টানা ৬ মাস পেঁয়াজে কষ্ট দিচ্ছে দেশের মানুষকে। এখনও ১০০ টাকার ওপরে কিনতে হচ্ছে পেঁয়াজ। তা ছাড়া চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, আদা, রসুনসহ বেশ কয়েকটি নিত্যপণ্যের অতিরিক্ত দামে অস্বস্তিতে রয়েছে সাধারণ মানুষ। চালের দাম বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফা। এর মধ্যেই বিদ্যুৎ ও পানির মূল্যবৃদ্ধি পণ্যমূল্যকে আরও উসকে দেবে, বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়।
ক্যাবের জরিপ তথ্যমতে, গত এক বছরে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। বিপরীতে আয় বেড়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। আয়-ব্যয়ের ব্যবধান বেড়েছে ১০-১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস, নিত্যপণ্য, বাড়িভাড়া, যাতায়াত ব্যয় বেড়েছে বেশ কয়েকগুণ। পারিবারিক ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কমে যাচ্ছে সঞ্চয়।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন জুলফিকার আলী। দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্বামী-স্ত্রী মিলে পাঁচজনের সংসার তার। থাকেন রাজধানীর কল্যাণপুরে। বাড়তি আর কোনো আয় নেই তার, তাই এই বেতনেই সবকিছু সামাল দিতে হয়। মাঝেমধ্যে টান পড়ে সংসারে, তখন হাত পাততে হয় আত্মীয়-স্বজন বা অফিসের কলিগদের কাছে। অর্থাৎ ধারদেনা করে চলতে হয় অনেক সময়। এর মধ্যে যদি আবারও বিদ্যুৎ ও পানির জন্য বাড়তি টাকা গুনতে হয় তা হলে কীভাবে টিকে থাকবেন এই ঢাকা শহরে সে ভাবনাতেই এখন তিনি দিশেহারা।
তিনি বলেন, প্রতি মাসই দুশ্চিন্তায় পার করতে হয়। কারণ যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে তাতে তো আর কুলাতে পারছি না, আমাদের তো আর আয় বাড়ছে না। তা হলে আমরা কীভাবে বাঁচব। বেতন যা পাই তার অর্ধেক চলে যায় বাড়িভাড়ায়। দুই সন্তানকে স্কুলে দিয়েছি, তাদের পেছনে বড় খরচ আছে। ছোট সন্তানের জন্য দুধ কেনা থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই ব্যয় করতে হয়। এসব প্রয়োজন মিটিয়ে কত আর থাকে? যেটুকু থাকে তা দিয়েই কোনো রকমে ডাল-ভাত খেয়ে টিকে আছি এই শহরে। কিন্তু আর কতদিন টিকতে পারব জানি না, আমাদের পীঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, আমাদের জীবনযাত্রায় আর বোঝা চাপাবেন না।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে যেহারে এখন দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অপচয় হচ্ছে সেগুলো যদি রোধ করা যেত তা হলে সরকারকে বিদ্যুৎ, পানি বা অন্য কিছুর দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ত না। অথচ সেদিকে সরকারের কোনো নরজ নেই, খালি কষ্ট বাড়াচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের। এভাবে একের পর এক জিনিসের দাম বাড়িয়ে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
আরেক অর্থনীতিবিদ এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, দেশে গ্যাসের মজুদ কমে যাচ্ছে। এজন্য হয়তো ধীরে ধীরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। তাই বলে এভাবে দাম বাড়িয়ে জনগণকে কষ্ট দিয়ে নয়, বরং সরকারের উচিত এখন বিদ্যুতে ব্যয় কমানোর জন্য কুইক রেন্টালের মতো অতি ব্যয়বহুল প্রকল্প থেকে সরে আসা।
এমনিতেই এখন দেশের সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে এ সময় এক সঙ্গে পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। যেহেতু সরকার পানি-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই ফেলেছে, সেহেতু সামনের বাজেটে যেন সাধারণ মানুষের উপকারে আসে এমন কিছু বিষয় রাখা উচিত। বিশেষ করে করমুক্ত আয় সুবিধা বাড়ানো যেতে পারে। তা ছাড়া সরকার চাইলে অনেক পণ্যের শুল্ক কমিয়েও দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট কিছুটা লাঘব করতে পারে।
ঢাকা ব্যুরো চীফ, ১ মার্চ ২০২০