Home / সারাদেশ / মেয়ে নিতে দুবাই থেকে ঢাকায় আসেন ড্যান্স ক্লাবের মালিকরা
Dance

মেয়ে নিতে দুবাই থেকে ঢাকায় আসেন ড্যান্স ক্লাবের মালিকরা

বাংলাদেশের ড্যান্স একাডেমিতে ভর্তি হওয়া মেয়েদের গ্রুপ ধরে ছবি পাঠানো হয় দুবাইয়ে। ছবিতে চেহারা ও শারীরিক গঠন পছন্দ হলে দুবাই থেকে আসেন ড্যান্স ক্লাবের মালিক। নাচের পারফরম্যান্সের নামে ট্যুরিস্ট ভিসায় নিয়ে যায় দুবাই। এরপর তরুণীদের নাচানো হয় ক্লাবে। নাচ শেষে প্রতি রাতে তাদের বাধ্য করা হয় যৌন পেশায়!

দুবাইয়ের দুজন ড্যান্স ক্লাবের মালিককে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। (খবর জাগো নিউজ)

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের তারাবো মোড়ের সামনে থেকে চার তরুণীকে দুবাই নিয়ে যাওয়ার সময় ছয়জনের একটি সংঘবদ্ধ দলকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তারা হলেন- মো. অনিক হোসেন, মো. আক্তার হোসেন, মো. আফতাউল ইসলাম ওরফে পারভেজ, মো. মনির হোসেন ওরফে সোহাগ, আ. হান্নান ও মো. আকাশ।

তদন্তে র‌্যাব জানতে পারে, গ্রেফতার ছয়জন ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেন। তাদের মধ্যে অনিক হোসেন ও আক্তার হোসেন বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তরুণীদের সংগ্রহ করতেন। এসব তরুণীর পাসপোর্ট প্রস্তুতকারী দালাল আফতাউল ইসলাম। মনির হোসেন ও আবদুল হান্নান দুবাইয়ের ড্যান্স ক্লাবের মালিক এবং আকাশ ট্রাভেল এজেন্সির মালিক।

একসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদে ওই ছয়জন জানান, তারা প্রথমে নিম্নবিত্ত পরিবারের সুন্দরী মেয়েদের টার্গেট করেন। এক্ষেত্রে গার্মেন্টের মেয়েদের ওপরও নজর ছিল তাদের। এছাড়া বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্লিম ও সুন্দরী মেয়ে যাদের বাবা-মা নেই অথবা পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই- এমন তরুণীদের তারা টার্গেট করতেন। তাদের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। প্রাথমিক নির্বাচনের পর তাদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে ড্যান্স একাডেমিতে ভর্তি হতে বলা হয়। সেখানকার ফি অনেক কম। ড্যান্স একাডেমি থেকে মাসে একটি শো হয় ঢাকার বিভিন্ন থিয়েটারে।

তদন্তে আরও জানা গেছে, প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্নের পর ওই নারী পাচারকারী সিন্ডিকেটের এজেন্টরা তরুণীদের ছবি বিদেশের ড্যান্স বারের মালিককে পাঠান। ছবি দেখে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর ড্যান্স বারের মালিক অথবা তার প্রতিনিধি সরাসরি তরুণীদের নির্বাচনের জন্য ঢাকা আসেন। তাদের দেখার জন্য ঢাকার কোনো রেস্টুরেন্ট, হোটেল অথবা লং-ড্রাইভের নামে অত্যাধুনিক হাইস মাইক্রোতে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা মূলত অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও ভীত প্রকৃতির তরুণীদের টার্গেট করেন। যাতে ওই তরুণী পরে পুলিশ বা কারও কাছে মুখ খুলতে সাহস না দেখায়। চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত তরুণীদের পাসপোর্ট তৈরির ব্যবস্থা করেন পাচারকারী সিন্ডিকেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য। ট্রাভেল এজেন্সির মালিকের মাধ্যমে নথিপত্র ম্যানেজ করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে তারা তরুণীদের ট্যুরিস্ট ভিসা করিয়ে দেন।

এরপর ঢাকার বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিসারের মুখোমুখি হলে কী বলতে হবে সে বিষয়ে তাদের আলাদাভাবে ব্রিফ করা হয়। ড্যান্স বারের মালিক নিজ খরচে তরুণীদের নতুন ও মডার্ন জামা-কাপড় কিনে দেন। যাতে তাদের দেখে উচ্চবিত্ত মনে হয়। ইমিগ্রেশন অফিসার তাদের দেখে যেন সন্দেহ না করেন। এছাড়া তাদের সেখানো হয়, যদি ইমিগ্রেশন অফিসার তাদের দুবাই যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেন তাহলে তারা যেন ‘ঘুরতে যাই’ বলে উত্তর দেন। এছাড়া ইমিগ্রেশন অফিসারের পাল্টা কিছু প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাদের বুর্জ খলিফা, জুমেইরাহ বিচ, বুর্জ আল আরবের মতো ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর নাম সেখানো হয়।

তদন্ত সূত্র আরও জানায়, প্রতিটি মেয়ে দেশের বাইরে পাচারের জন্য তারা ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে পান।

রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, এসব তরুণী দুবাই বিমানবন্দরে নামামাত্র সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাদের রিসিভ করে মেসে বা ভাড়া করা বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে তাদের পাঁচ-সাত দিন রাখা হয়। তাদের বের হতে দেয়া হয় না। সপ্তাহখানেকের মাথায় তাদের প্রস্তুত করে ড্যান্স বারে নেয়া হয়। ড্যান্স বারের বাইরেও তাদের যেতে দেয়া হয় না।

দুবাই থেকে ফিরে আসা কয়েকজন তরুণী জাগো নিউজকে জানান, তারা স্বেচ্ছায় দুবাইয়ের ড্যান্স বারে গেলেও প্রতিনিয়ত অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে রাজি ছিলেন না। তবে সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাদের জোর করে বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে যৌনকাজের জন্য প্রস্তুত করতেন। বার বন্ধ হওয়ার পর কোনো খদ্দের কোনো তরুণীকে পছন্দ করলে ওই বারের মালিকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে ওই তরুণীকে একরাত বা কয়েক দিনের জন্য ভাড়া করেন।

গ্রেফতার হওয়া ছয়জনের সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া স্বর্ণা ইসলাম (ছদ্মনাম) বলেন, স্বামীর পক্ষে একা সংসার চালানো খুবই জটিল হয়ে পড়েছিল। আমি যেকোনো একটি চাকরির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম। তখনই এক আত্মীয়ের মাধ্যমে দুবাইয়ের একটি ড্যান্স ক্লাবে চাকরির অফার পাই। আমার আত্মীয় আমাকে নারায়ণগঞ্জের অনিক ড্যান্স গ্রুপে নিয়ে যায়। অনিক আমাকে বলে, সে আমাকে নাচ শেখাবে এবং দুবাই পাঠিয়ে মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি দেবে। সে আরও বলে যে, শুধু নাচ শিখলেই পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকিট বিনামূল্যে দেয়া হবে। এমন প্রলোভনে আমি তিনদিন তার প্রতিষ্ঠানে নাচ শিখি। এরপরই র‌্যাব এসে গ্রেফতার করে। আমাকে পাচারের বিষয়ে খুলে বললে আমি উপলব্ধি করি যে, অনেক বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছি।

আগে বিভিন্ন সংস্থা মানবপাচারকারীদের গ্রেফতার করলেও দুবাইয়ের ড্যান্স ক্লাবে মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট এবারই প্রথম ধরা পড়ল। বিষয়টি আগে অজানা ছিল। এ সিন্ডিকেটকে গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ৫০টি পাসপোর্ট, ৫০টি বিমান টিকিট ও ৫০টি ভিসার স্টিকারসহ মোট দেড় লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।

দুবাই থেকে ফেরত আসা দুই নারী জানান, তারা ১৩ দিনের মাথায় দুবাই থেকে ফেরত এসেছেন। সেখানে নাচের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অসামাজিক কার্যকলাপ ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনও করা হয়।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এ ধরনের মোট ৫০ পাচারকারীর সন্ধান তারা পেয়েছেন। দুবাইয়ের তিনটি ড্যান্স ক্লাব ও কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সি এমন কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। তাদের মাধ্যমে থাইল্যান্ড, দুবাই, আবুধাবি, মালয়েশিয়ায় কমপক্ষে ৭২১ নারী পাচার হয়েছেন। এসব দেশে তিন মাসের ট্যুরিস্ট ভিসা দেয়া হয়। পাচারকারীরা আড়াই মাসের মাথায় তরুণীদের ফিরিয়ে এনে পরে আবারও তিন মাসের জন্য ভিসা করিয়ে নেন।

পাচারের শিকার এমন দুজনের সঙ্গে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বুকিত বিনতাং এবং থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের সুকুম্ভিটে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। রুম্পা (ছদ্মনাম) নামের এক চাকমা তরুণী জাগো নিউজকে জানান, তাকে একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি দেয়ার কথা বলে আনা হয় কুয়ালালামপুর। প্রথম কয়েক দিন রেস্টুরেন্টের ওয়েটার হিসেবে কাজ করার পর তাকে একদিন চীনের এক ব্যক্তির সঙ্গে রাত কাটাতে বলেন পাকিস্তানি মালিক। এর প্রতিবাদ করলে তাকে ব্ল্যাকমেইলের জন্য জোর করে কিছু আপত্তিকর ছবি তুলে রাখা হয়। এরপর তিনি যেতে বাধ্য হন।

তানিয়া (ছদ্মনাম) নামে কক্সবাজারের মহেশখালীর এক তরুণী ব্যাংককে এ প্রতিবেদককে জানান, তাকে বাংলাদেশে বলা হয়েছিল, থাইল্যান্ড এসে ম্যাসেজ পার্লারে কাজ করলে মাসে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আয় সম্ভব। এ আশায় রহিম শেখ নামে এক দালালের সঙ্গে থাইল্যান্ড আসেন। এখানে এসে জানতে পারেন, তার ভিসাটি ‘ট্যুরিস্ট’ বা পর্যটন ভিসার। তাকে কেউ কাজে না নিলে বাধ্য হয়ে পতিতাবৃত্তি শুরু করেন।

ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচারের বিষয়ে তদন্ত ও অভিযান চলমান রেখেছে র‌্যাব। র‌্যাব-১১ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. আলেপ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ধরনের আর কোনো সিন্ডিকেট থাকলে সেগুলো ভেঙে দেয়া হবে। পুরো চক্র গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত অভিযান চলমান থাকবে।

বার্তা কক্ষ,১০ ডিসেম্বর ২০১৯