বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ প্রবাসীদের আয়। কাঁচামাল আমদানির খরচ বাদ দিলে তৈরি পোশাক খাতের চেয়ে তিন গুণ বেশি নিট বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে।
এ প্রবাসী আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আসে সৌদি আরবের শ্রমবাজার থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের দেশে ফেরত আসার খবর আসছে।
বর্তমানে বিশ্বের ১৬২ টি দেশে ১ কোটি ১৪ লাখ ৬৪ হাজার ৯৪৩ জন বাংলাদেশি শ্রম-অভিবাসী কাজ করছেন। তবে বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমবাজার মূলত: ১১টি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দেশগুলো হলো সৌদি আরব,সংযুক্ত আরব আমিরাত,ওমান,মালয়েশিয়া,সিঙ্গাপুর,কুয়েত, কাতার,বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান ও লিবিয়া।
এর বাইরে অন্য দেশগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিকের হার তুলনামূলক কম। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবেই ১৫-২০ লাখ শ্রমিক কর্মরত।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী,চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন প্রায় ১৮ হাজার কর্মী। এর আগে ২০১৭ সালে ফিরেছেন ১৬ হাজার ও ২০১৮ সালে ফিরেছেন ২৪ হাজার কর্মী। গত ১০ বছরে দেশটি থেকে শূন্য হাতে ফিরে এসেছেন দুই লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মী।
প্রবাসী শ্রমিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। তারা আত্মীয়স্বজনসহ নানা সূত্রে ঋণ নিয়ে জমিজিরাত বন্ধক রেখে বা বিক্রি করে সচ্ছল জীবন গড়ার আশায় বিদেশে চাকরি করতে যান। তাদের অনেককেই ভ্রমণের খরচ উঠে না আসতেই দলে দলে ফিরে আসতে হচ্ছে। অনেকেই কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের হয়রানি ও বৈষম্যের অভিযোগ তুলছেন। এটা স্পষ্ট যে, তারা নানাভাবে হয়রানী হচ্ছেন। এক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দায়ী অনেকটাই ।
কাজ করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরছেন বহু শ্রমিক। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী কর্মজীবী নারীদের হয়রানিসহ নানা বৈষম্য চলছে। মাত্র সাড়ে তিন বছরে প্রায় সাড়ে তিনশ নারীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
২০১৬ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৩১১ নারী শ্রমিকের লাশ বাংলাদেশে আনা হয়েছে। এদের অধিকাংশই সৌদি আরব থেকে এসেছে। সব থেকে ভয়াবহ হলো,এদের মধ্যে ৫৩ জনই আত্মহত্যা করেছেন। এর থেকে দ্বিগুণেরও বেশি,১২০ জন স্ট্রোকে এবং ৫৬ জনের দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটেছে। বিদেশগামী নারীদের বেশিরভাগের বয়স ২০ থেকে ৪০-এর মধ্যে। ১২০ নারীর স্ট্রোকে মৃত্যু উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো সংবাদ।
অভিবাসী শ্রমিক,তা তারা বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন,তারা যেমন নিজ দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণকারী,তেমনি স্বাগতিক দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রয়েছে তাদের বিশাল অবদান। অভিবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা গোটা বিশ্বে বিশেষভাবে স্বীকৃত।
তদুপরি সৌদি আরবের সঙ্গে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের বিশেষ সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে সুবিদিত। সৌদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অধিকতর বোঝাপড়ার বিষয়টিও আলোচিত। কিন্তু বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরব থেকে ফেরত আসছেন ।অথচ সে বিষয়ে দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয়ের আশাপ্রদ তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
এক্ষেত্রে প্রবাসীকল্যাণ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। যোগ্য ও বাংলাদেশি কর্মীদের বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে পাঠাতে হবে। আকামা বা কর্মের অনুমোদনপত্র হস্তান্তরে সতর্কতা বাড়াতে হবে। সৌদি আরবে বাংলাদেশিদের জন্য পরামর্শ ও সহযোগিতার ব্যবস্থা বাড়াতে হবে।
সৌদি আরবের শ্রমবাজার নিয়ে যেভাবে অপরাধ চক্র গড়ে উঠেছে,তাতে সেখানে গিয়ে তাদের খপ্পরে পড়া অস্বাভাবিক নয়। এ চক্রের বিরুদ্ধে সরকারের তৎপরতা দরকার।
প্রবাসে যাওয়ার আগে প্রত্যেক শ্রমিককে নীতিনৈতিকতা ও সংশ্লিষ্ট দেশের আইনকানুন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে সেখানে দূতাবাস কর্মকর্তারা নিয়মিত কাউন্সেলিং করবেন, শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন কেউ বিপদে পড়লে সহায়তা করবেন এটাই প্রত্যাশিত।
পাশাপাশি, যারা দেশে ফেরত এসেছেন তারা যাতে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন এবং পুনর্বাসিত হতে পারেন, সেই বন্দোবস্ত করাও জরুরি। আমরা আশা করি দেশে পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সু-দৃষ্টি দেবেন ।
সম্পাদকীয় , ২৯ অক্টোবর ২০১৯
এজি
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur