জিল হোসেনের জীবনের গল্পটা অন্য সবার চেয়ে আলাদা। স্নাতক পাসের পর বন্ধু-সহপাঠীরা যখন একে একে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন, তখন তাঁকে আইনি লড়াইয়ে যেতে হয়েছে সেই সনদ পেতে।
আদালতের রায়ের পর ৪৭ বছর বয়সে তাঁর হাতে পরীক্ষা পাসের মার্কশিটের (নম্বরপত্র) সনদ আসে। জিল হোসেনের বয়স এখন ৬৯। এরও বহু আগে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স (আগে ছিল ২৭ বছর, এখন ৩০ বছর) পেরিয়ে যায় তাঁর। তিনি পড়তেন ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতক পরীক্ষা দিয়েছিলেন ২৩ বছর বয়সে।
জিল হোসেনের বয়স এখন ৬৯। অসুস্থতার কারণে ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না। যা বলেন, তা–ও অস্পষ্ট। তবে তাঁর আইনি লড়াই শেষ হয়নি। এখন অপেক্ষা করছেন ক্ষতিপূরণের জন্য। সনদ হাতে পেতে এবং ক্ষতিপূরণের জন্য করা মামলায় ইতিমধ্যে কেটে গেছে ৪৪ বছর। এখন বিষয়টি হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
পরিবার ও মামলার নথিতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে জিল হোসেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের (কৃষি) পরীক্ষার্থী ছিলেন। এই পরীক্ষা হয় ১৯৭৩ সালে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার ফলাফলে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এই ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করেন তিনি।
কিন্তু সে আবেদনে কাজ হয়নি। এরপর ১৯৭৫ সালে তিনি আবার পরীক্ষায় অংশ নেন, কিন্তু তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে তিনি মামলা করেন।
মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর প্রাপ্ত নম্বরের (১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায়) সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এই মামলায় আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য করানোকেও বেআইনি ঘোষণা করেন।
এই রায়ের বিরুদ্ধে জজ আদালতে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর জজ আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট হাইকোর্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠান।
পরে ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার জেলা জেলা জজ আদালতে আপিল করে, যা নামঞ্জুর হয়। পরে হাইকোর্টে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ওপর ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেওয়া হয়। এই রায়ে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।
এক দশক পরে পাস মার্ক দিয়ে সার্টিফিকেট
মামলা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাইকোর্টের রায়ের পর ১৯৮৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিল হোসেনের একটি আবেদন গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে তাঁকে পাস মার্ক দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর সার্টিফিকেট (নম্বরপত্রের সনদ) দেয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন তাঁর বয়স ৪৭ বছর অর্থাৎ সরকারি চাকরির বয়সসীমা শেষ।
এরপর ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে নিম্ন আদালতে মামলা করেন জিল হোসেন। এতে দাবি করা হয়, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তাঁর জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ক্ষতিপূরণ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ অক্টোবর রায় দেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে ২ কোটি টাকা জিল হোসেনকে দিতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে আইনি পরামর্শ ও সহায়তার জন্য গত বছর সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কার্যালয়ের দ্বারস্থ হন জিল হোসেনের ছোট ছেলে নূর মোহাম্মদ। এর ধারাবাহিকতায় লিগ্যাল এইড কমিটির পক্ষ থেকে গত বছরের ৩০ অক্টোবর জিল হোসেনের পক্ষে হাইকোর্টে মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাসকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায়ের বিরুদ্ধে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করা আপিল গত ১০ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি। ইতিমধ্যে বিষয়টি হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চে উপস্থাপন করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি শেষে আগামী ১৩ অক্টোবরের পর আপিলের ওপর শুনানি হতে পারে। তবে এ ধরনের প্রথম আপিল শুনানির ক্ষেত্রে আপিলকারী পক্ষের আইনজীবী আদালতে উপস্থিত না থাকলে শুনানি হয় না। যে কারণে ১০ বছর চলে গেছে। এ ধরনের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক হওয়া দরকার।
এ বিষয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ছাইফুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি এখন বিচারাধীন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমঝোতা করতে ভুক্তভোগীকে বেশ কয়েকবার বলা হয়েছিল। বিষয়টি মানবিক বলে তাঁর যোগ্য সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি প্রদানসহ আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করতে আন্তরিক।
সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছা গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকেন জিল হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের ওই ঘটনার পর তিনি আর কোনো চাকরিতে ঢোকার সুযোগ পাননি। ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালিয়েছেন। তাঁর চার ছেলে, চার মেয়ে। অস্পষ্ট স্বরে তিনি যা বলেছেন তা অনেকটা এ রকম—৪৪ বছর ধরে মামলা চলছে, শেষ তো হয় না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান তিনি।
জিল হোসেনের ছোট ছেলে নূর মোহাম্মদ সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র। তিনি বলেন, মামলা চালাতে গিয়ে জমিজমা যা ছিল, তার প্রায় সবই বিক্রি করে দিয়েছেন বাবা। ২০১০ সালে তিনি স্ট্রোক করেন। দুই বছর পর আবার স্ট্রোক হয় তাঁর।। এখন খুব বেশি হাঁটাচলা করতে পারেন না, কথাও স্পষ্টভাবে বলতে পারেন না।
১৯৯৭ সালে মার্কশিট পাওয়ার পর বাবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা (১৯৯৯ সালে) করেন। ওই বছরই প্রধানমন্ত্রী ২৫ হাজার টাকা অর্থ অনুদান দেন। এ অর্থের সঙ্গে আরও ৩৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করে ক্ষতিপূরণের মামলাটি করেছেন বাবা। তাঁর শেষ ইচ্ছা মামলার রায় দেখে যাওয়া। (প্রথম আলো)
বার্তা কক্ষ, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯